অতিরিক্ত ডিআইজির অতিরিক্ত অপকর্মের সারথী তার স্ত্রী ও রুপগঞ্জ থানার সাবেক ওসি

প্রকাশিত

সত্তুর বছরের বৃদ্ধ জাহের আলী ৬২বিঘা জমি ৩টি দামী প্রাইভেটকার নিয়ে শেষ জীবনে সুখে শান্তিতেই দিনানিপাত করছিলেন। সম্পত্তিই তার কাল হয়ে দাঁড়াবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। ২০১৮ সালে ১০ জুলাই একটি ফোন কল জাহের আলীর জীবনের সব হিসেবনিকেষ পাল্টে দেয়। সেই অভিশপ্ত ফোনটি করেন তৎকালীন রূপগঞ্জ থানা ও সোনারগাঁ থানার বর্তমান ওসি মনিরুজ্জামান মনির। ফোন করে তাকে থানায় যেতে বলেন। ওসির ফোন পেয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও মেয়ের জামাই আবু তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি থানায় যান। সেখান থেকে তাদের পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর থেকে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। রাতেও তারা ফিরে না আসায় পরিবারের সদস্যরা রুপগঞ্জ থানায় জিডি করতে যান। কিন্তু থানা পুলিশ জিডি না নিয়ে উল্টো তাদের হুমকি দিয়ে বলে, ‘এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবেন না। আর বাড়াবাড়ি করলে পরিবারের সবাইকে মেরে গুম করে নদীতে ফেলে দেয়া হবে।’ এর কয়েকদিন পর পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, পুলিশ সদর দফতরে নিয়ে যাওয়ার পর জাহের আলী ও তার জামাইকে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি আটক থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের সব জমিজমা লিখে নিতে চাচ্ছে পুলিশ। ঘটনাটি রুপগঞ্জ থানার। মামলার এজহারসুত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী বক্তবাড়ি এলাকার জাহের আলীকে ফোন করে থানায় ডেকে নেয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছুদিন নিখোঁজ ছিলেন।

পুলিশি নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনায় বৃদ্ধ জাহের আলী বলেন, ‘আমাদেরকে পুলিশ সদর দফতরের চার তলায় অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেলের রুমে নিয়ে যায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। সেখানে সবার হাতে হাতকড়া পরানো হয়। রাতে পুলিশ সদর দফতরে ডিবির লোকজন এসে হাজির হয়। তারা আমাদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর পর জমিজমা লিখে দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে পুলিশ।

ডিবির ইন্সপেক্টর দীপক কুমার দাস আমাদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ভয়ও দেখান। একপর্যায়ে ডিবি কার্যালয়ে আটক অবস্থাতেই আমরা মোট ১০টি দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য হই। ১১ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ১৩ দিন আমি এবং আমার ছেলে আবদুল মতিন ও মেয়ে জামাই আবু তাহের ডিবি অফিসে আটক ছিলাম। প্রতিদিনই আমাদের নির্মমভাবে পেটানো হতো। ভয়ভীতি ও নির্যাতনের মুখে আমাদের মালিকানায় যেসব ব্যক্তিগত জমি ছিল তার সবই অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল ও তার স্ত্রীর নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সবকিছু লিখে দেয়ার পরও মুক্তি পাইনি।

১৬ জুলাই আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি প্রতারণার মামলা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ২৫ জুলাই ফের আমাদের রিমান্ডে আনে ডিবি পুলিশ। ২৬ জুলাই আদালতের আদেশে আনুষ্ঠানিক রিমান্ডে থাকাবস্থাতেই আমাদের কাছ থেকে আরও দুটি দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়া হয়। এভাবে আমাদের বসতভিটাসহ মোট সাড়ে ৬২ বিঘা জমি লিখে নেয়া হয়েছে। যার মূল্য অন্তত ৬০ কোটি টাকা।’

বৃদ্ধ জাহের আলী আরো বলেন, জমিজমাসহ সর্বস্ব লিখে দেয়ার পরও আমাদের জেলে পাঠানো হয়। আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একের পর এক প্রতারণার মামলা হতে থাকে। ঢাকার শাহবাগ, ডেমরা থানায় একটি করে দুটি এবং রূপগঞ্জ থানায় ১১টি প্রতারণার মামলা হয় । আদালত একটি মামলায় জামিন দিলেই আরেকটি পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখানো হতো। ফলে জামিনের শত চেষ্টা করেও আমরা কারাগার থেকে বের হতে পারিনি। প্রায় ১ বছর আমাদের কারাগারে থাকতে হয়েছে।’

গত ১৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের ১৫ নম্বর আদালতের বিচারক দেবব্রত বিশ্বাসের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল মতিনের স্ত্রী আফরোজা আক্তার আঁখি । ওই বিচারক মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি ওই আদালতের হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস তদন্ত করছেন।

অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) গাজী মোজাম্মেল হকসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলায় অপর আসামিরা হলেন- পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হকের স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা রমনা জোনাল টিমের দীপক কুমার দাস, নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মনির, রাজধানীর ডেমরার সাব-রেজিস্ট্রার আফছানা বেগম, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী হানিফ আলী শেখ, ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের ঢাকার নয়াবাজার শাখার এক্সিকিউটিভ অফিসার সাজ্জাদুর রহমান মজুমদার, দলিল লেখক মো. জাকির হোসেন, জসিমদ্দিন, ইমরান হোসন, আনন্দ হাউজিং এর পরিচালক চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, নজরুল ইসলাম, এবিএম সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলম, আব্দুর রহিম, তারিকুল মাষ্টার, সিদ্ধার্থ, গনেশ, পলাশ ও সৈকত।

জাহের আলী বলেন, তার ছেলেমেয়েসহ পরিবারের সবাই এখন পলাতক। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে খেয়ে না খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তিন ছেলে আবদুল মতিন, রফিকুল ইসলাম ও সফিকুল ইসলাম, ভাই আলী হোসেন, ভাতিজা আনিস, জামাই আবু তাহের, পুত্রবধূ ও মামলার বাদী আফরোজা আক্তার আঁখি, বৃদ্ধ স্ত্রী ফিরোজা বেগম। এমনকি ১০ বছরের নাতনি তাসনিম পুলিশের ভয়ে ১ বছর ধরে স্কুলেও যেতে পারছে না। ৫ বছরের নাতি হামিম ও মেয়ে হেলেনা বেগমের রাত কাটছে এখানে-সেখানে। পুলিশের ভয়ে আমরা একেক দিন একেক এলাকায় থাকি।

ভুক্তভোগীরা জানান, আদালতে গাজী মোজাম্মেলের বিরুদ্ধে মামলা করার পর বাদী আফরোজা আক্তার আঁখিকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। এছাড়া মামলার সব সাক্ষীর নামেও একাধিক মামলা দেয়া হয়েছে। জমিজমা ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত ৩টি মূল্যবান গাড়িও লিখে নেয়া হয়। গাড়িগুলোর নম্বর হচ্ছে- ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৯২৫১ (টয়োটা হ্যারিয়ার), ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২৫২৮ (হোন্ডা-সিআরভি), ঢাকা মেট্রো ঘ-৩৩৪৬৫২ (টয়োটা এলিয়ন)। বাসার গ্যারেজ থেকে পুলিশ যখন একে একে তিনটি গাড়ি বের করে নিয়ে যায় তখন সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। আদালতে সেই ফুটেজ জমা দেয়া হয়েছে। তিনটি গাড়ির মধ্যে হ্যারিয়ার মডেলের গাড়িটি এখন নিজেই ব্যবহার করছেন গাজী মোজাম্মেল হক এবং তার তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল। হোন্ডা সিআরবি মডেলের আরেকটি গাড়ি ব্যবহার করছেন মোজাম্মেলের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদর দফতরের এএসআই নজরুল ইসলাম। এছাড়া ডেমরা সারুলিয়া এলাকায় গাজী মোজাম্মেলের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে অপর একটি গাড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে।

মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়- এরা একদলভুক্ত, ঠক, প্রতারক, আইন অমান্যকারী, ভূমিদস্যু এবং অপরাধ চক্রের সক্রিয় সদস্য। অপরাধ আমলে নিয়ে আদালতের কাছে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি অথবা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আদালত ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন। মামলাটি এখন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-এর আদালতে বিচারাধীন।

ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ১৫ নম্বর আদালতের পেশকার তানভির মামুন রোববার বলেন, এ মামলায় বেশিরভাগ আসামি পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় গোপনীয়তার সঙ্গে তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে চারজন সাক্ষীর বক্তব্য শুনেছেন আদালত।

জানতে চাইলে মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী হাসনা খাতুন বলেন, ‘রিমান্ডে থাকাবস্থায় জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়ার অভিযোগ উপস্থাপন করা হলে আদালত বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এটা কিভাবে সম্ভব? তখন আমরা সংশ্লিষ্ট জমির দলিল থেকে শুরু করে অন্যান্য সব প্রমাণপত্র আদালতে উপস্থাপন করি। পুরো ঘটনা শুনে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন।’

জমি দখলের অভিযোগ ও আদালতে দায়েরকৃত মামলার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ২৬ মে পুলিশ সদর দফতরের চতুর্থ তলায় নিজের অফিস কক্ষে বসে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দীর্ঘ সময় কথা বলেন অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, জাহের আলী তার পূর্বপরিচিত। ২০০৬ সাল থেকে তিনি তাকে চেনেন। আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি নামের একটি আবাসন প্রকল্পের প্রধান হিসেবে জাহের আলীর মাধ্যমে তিনি জমিজমা কিনতেন। তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি। তার মাধ্যমে প্রকল্পের জন্য মোট ১৫১ বিঘা জমি কেনা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে হিসাব করতে গিয়ে দেখা যায়, জাহের আলী অনেক টাকা নয়ছয় করেছেন। হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেছে, তার কাছে আমার ৩৩ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ টাকা দেয়ার জন্য আমি তাকে অনুরোধ করলে সে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করে। এ নিয়ে কয়েক দফা মীমাংসা বৈঠকও হয়। একপর্যায়ে জাহের আলী স্ট্যাম্পে লিখিত দেন তিনি সমুদয় টাকা পরিশোধ করবেন। এমনকি পাওনা টাকা না দিতে পারলে তার ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিজমা ও সম্পদ আমার হাউজিংয়ের নামে লিখে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু ৩ মাস পার হয়ে গেলেও জাহের আলী তার কথা রাখেননি। এ কারণে তাকে গ্রেফতার করে আনা হয়।

এ প্রসঙ্গে জাহের আলীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন- ‘অস্ত্রের মুখে জোরর্পূবক আমার কাছ থেকে স্ট্যাম্পে সই নেয়া হয়। এমনকি স্ট্যাম্পে কী লেখা আছে সেটিও দেখতে দেয়া হয়নি। কিন্তু আমি হলফ করে বলছি, অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক আমার কাছে ১টি টাকাও পাওনা নেই। সবকিছু করেছেন ক্ষমতার জোরে। উনি ভেবেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে। উল্টো তিনি বহু প্রভাবশালী পুলিশকে পক্ষে রাখতে তাদের বিনামূল্যে আনন্দ হাউজিংয়ে প্লট দেয়ার প্রলোভন দেন। ওই লোভে পড়ে পুলিশের কেউ কেউ গাজী মোজাম্মেলের কথামতো আমার পুরো পরিবারের ওপর হামলে পড়েন।’

(সুত্র:যুগান্তর, এনটিভি, চ্যানেল ২৪ ও যমুনা টিভি)

আপনার মতামত জানান