উসমানীয় খেলাফতকে রক্ষা করেছিলেন যিনি

প্রকাশিত

মুসলিম ইতিহাসে নারীদের রাষ্ট্র পরিচালনার ঘটনা নিতান্তই বিরল। তবে পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতার নিয়ন্তা হয়ে ওঠা এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ঘটনা বিরল নয়। মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে উসমানীয় সম্রাজ্ঞীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়েছে। হুররম সুলতান থেকে খাদিজা তুরহান পর্যন্ত (১৫৩৩ থেকে ১৬৫৬ খ্রি.) ১২৩ বছরকে বলা হয় ‘রাণিদের শাসনকাল’।

দাসি থেকে সম্রাজ্ঞী : খাদিজা তুরহান ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ইউক্রেন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। এক যুদ্ধে তিনি তাতারদের হাতে বন্দি হন এবং ১২ বছর বয়সে উপহার হিসেবে তাঁকে তোপকাপি প্রাসাদে প্রেরণ করা হয়। হেরেমে তিনি সুলতানা কোসেমের অধীনে ছিলেন। সম্রাজ্ঞী তাঁকে ছেলে ইবরাহিমের সেবায় নিযুক্ত করেন। সম্রাজ্ঞী কোসেম ছিলেন সুলতান প্রথম আহমদের স্ত্রী এবং সুলতান চতুর্থ মুরাদ ও সুলতান ইবরাহিমের মা। সুলতান প্রথম আহমদ অল্প বয়সে মারা গেলে তাঁর ছেলে সুলতান চতুর্থ মুরাদ ১১ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তিনিও যুবক বয়সে মারা যান। ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইবরাহিম ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

খাদিজা তুরহানের গর্ভে ইবরাহিমের এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম গ্রহণ করে। ছেলে মুহাম্মদই ছিল সুলতান ইবরাহিমের প্রথম ছেলে। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী জন্ম গ্রহণ করায় উসমানীয় সাম্রাজ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলেও সুলতান খুব সামান্যই আনন্দ প্রকাশ করেন। খাদিজা তুরহান সন্তানের অধিকারের ব্যাপারে সরব হলে ইবরাহিম ছেলে মুহাম্মদকে পানির হাউসের মধ্যে ফেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে সুলতান ইবরাহিম ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ভোগ-বিলাসে মত্ত। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ব্যাপারে অমনোযোগী। ফলে তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র সাত বছর না যেতেই তাঁর সম্রাজ্ঞী কোসেমসহ সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারকরা তাঁকে পদচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশেষে তিনি জানিসারি সৈনিকদের হাতে নিহত হন।

যেভাবে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে : সুলতান ইবরাহিমের মৃত্যুর পর মাত্র ছয় বছর বয়সে ছেলে মুহাম্মদ ‘চতুর্থ মুহাম্মদ’ নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুলতান চতুর্থ মুহাম্মদ শিশু হওয়ায় প্রচলিত নিয়ম অনুসারে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ‘রানি মাতার’ হাতে। তবে সম্রাজ্ঞী খাদিজা তুরহানের বয়স ও অভিজ্ঞতা অল্প হওয়ায় সুলতানের দাদি সম্রাজ্ঞী কোসেমের হাতে কিছু ক্ষমতা থেকে যায়। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সুলতানা কোসেম নিহত হওয়ার পর খাদিজা তুরহান ‘রানি মাতা’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং নাবালক সন্তানের পক্ষে সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। রাজপরিবারের যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা রোধ করতে খাদিজা তুরহান ছিলেন অত্যন্ত তৎপর। তিনি সন্তানের সার্বিক কর্মকাণ্ডে পাশে থাকতেন। সভাসদদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, নিজে রাষ্ট্রীয় সভায় উপস্থিত হতেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতেন। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে নিজের ক্ষমতা আরো সুসংহত করেন।

যেভাবে রক্ষা করেন উসমানীয় সাম্রাজ্য : খাদিজা তুরহানের সবচেয়ে অবদান হলো তিনি উসমানীয় রাজপরিবারে ভ্রাতৃহত্যার পথ বন্ধ করেন। মূলত এর মাধ্যমেই তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। একাধিক উসমানীয় সুলতান নিজের সৎ ভাইকে হত্যা করেছেন নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে। যেমন সুলতান তৃতীয় মুরাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর তাঁর সব সৎ ভাইকে হত্যা করেন। সুলতান তৃতীয় মুরাদ মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী সাফিয়া পুত্র তৃতীয় মুহাম্মদকে ক্ষমতাসীন করতে সুলতানের ১৮ ছেলেকে একরাতে হত্যা করে। কিন্তু খাদিজা তুরহান এই ধারা পাল্টে দেন। তিনি তাঁর স্বামীর সন্তানদের জীবন রক্ষায় ভূমিকা রাখেন। সুলতান চতুর্থ মুহাম্মদ যখন সাবালক হন এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে চলে যায়, তখন তাঁর স্ত্রী রাবেয়া গুনলেশ প্রথম পুত্র মোস্তফার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতেন ভাই দ্বিতীয় সোলাইমান ও আহমদকে হত্যা করতে সুলতানকে প্ররোচিত করেন। খাদিজা তুরহান তাদের অপচেষ্টা রোধ করেন। এভাবেই তিনি উসমানীয় রাজপরিবারকে রক্তক্ষয়ী পথ থেকে সরিয়ে আনেন।

ইন্তেকাল : মূলত মুহাম্মদ পাশাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করার মাধ্যমে খাদিজা তুরহান রাজনৈতিকভাবে নির্ভার হন। ফলে তিনি নগর উন্নয়ন ও জনসেবায় আরো বেশি মনোযোগী হন। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে বেসিকতাস অঞ্চলে একটি জলপথ নির্মাণ করেন। তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ নির্মাণ করেন। একটি ইউরোপের দিকে এবং অপরটি এশিয়ার দিকে। প্রতিটি দুর্গে ছিল একাধিক মসজিদ, মাদরাসা, গোসলখানা ও বাজার। এ ছাড়া তিনি ইয়েনি কেমি মসজিদ নির্মাণের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন, যা ৫৭ বছর আগে সুলতানা সাফিয়া শুরু করেছিলন। রাজপরিবারের নারীদের নির্মিত প্রথম মসজিদ ইয়েনি কেমি মসজিদ। ১৬৮৩ সালে ইন্তেকাল করলে তাকে এই মসজিদের পাশেই দাফন করা হয়।

আপনার মতামত জানান