ইসলামে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব

প্রকাশিত

সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন আমাদের সবারই কাম্য। এর জন্য চাই দূষণমুক্ত স্বচ্ছ পরিবেশ। আর নির্মল ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষই আমাদের জীবনযাত্রার প্রাকৃতিক সঙ্গী।

স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রাণশক্তি অক্সিজেনসহ আল্লাহ প্রদত্ত জীবন-জীবিকার নানা উপায়-উপকরণে বৃক্ষই আমাদের অন্যতম নির্ভরতা। পরিবেশ গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের আয়তন অনুযায়ী বৃক্ষের প্রয়োজন শতকরা ২৫ ভাগ। অথচ বর্তমানে মাত্র ১৭ শতাংশ রয়েছে এই বৃক্ষ ও বনভূমি। তাই দেশের পরিবেশের ভারসাম্য ও সতেজতা ধরে রাখতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। প্রতিবছর শুধু ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ ও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জীবন-জীবিকার অনন্য অনুষঙ্গ এই বৃক্ষরোপণকে দিবসকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়। ইসলাম কিয়ামতের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যায় উৎসাহিত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯)

কোরআনে বৃক্ষরাজি ও প্রকৃতির বর্ণনা

বৃক্ষ আল্লাহ তাআলার বিশেষ নিয়ামতগুলোর একটি। জীবনোপকরণের উপাদান হিসেবে সবুজ-শ্যামল গাছগাছালি ও নানা রকম ফলদ বৃক্ষের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে এই অমূল্য নিয়ামত দান করে থাকেন। তা ছাড়া সবুজাভ বনায়ন ও বৃক্ষরাজি দিয়ে আল্লাহ এই পৃথিবীকে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিতও করেছেন।

বৃক্ষ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়।’ (সুরা : কাফ, আয়াত : ৭-৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদ্গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে।’ (সুরা : সাজদা, আয়াত : ২৭)

বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় শুধু পরিবেশই রক্ষা হয় না, বরং এই কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে অনেক সওয়াবও অর্জন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণের ফজিলত উল্লেখ করে সাহাবাদের উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) স্বরূপ গণ্য হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩২০)

অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৩৫৬৭)

ইসলামে অপ্রয়োজনে বৃক্ষনিধনের শাস্তি

গণমাধ্যমে প্রায়ই অকারণে বৃক্ষনিধনের খবর প্রকাশিত হয়, যা খুবই নিন্দনীয়। যে উপকারী বৃক্ষ আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশ গঠনে সহায়তা করছে, তা অহেতুক কর্তন করা কোনো বিবেকবান সচেতন মানুষের কাজ হতে পারে না। এভাবে বৃক্ষনিধন হতে থাকলে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে একসময় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। আজকের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষনিধনের বিরুদ্ধে কিছুটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, অথচ আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগেই ইসলাম অহেতুক বৃক্ষনিধনে কঠোরতা আরোপ করেছিল।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বরইগাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-কে এই হাদিসের অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই হাদিসের বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত্ত, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে ব্যক্তি অকারণে বা অন্যায়ভাবে মরুভূমির কোনো বরইগাছ কাটবে, যেখানে পথিক বা কোনো প্রাণী ছায়া গ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৩৯)

এমনকি নবীজি (সা.)সহ পরবর্তী সব খলিফা সেনাদের প্রতিপক্ষের কোনো গাছপালা বা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস না করতে নির্দেশ দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘তোমরা কোনো বৃক্ষ উৎপাটন করবে না।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৯৪৩০)

কারণ গাছ মহান আল্লাহর অমূল্য নিয়ামত। এটি ধ্বংস করলে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী গত আড়াই শ বছরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। শুধু উদ্ভিদ নয়, এর সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক পাখি, স্তন্যপায়ী এবং উভচর প্রাণীও।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বাভাবিক প্রত্যাশার চেয়ে ৫০০ গুণ দ্রুত ঘটেছে এসব উদ্ভিদের বিলুপ্তি, যা পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত খারাপ খবর। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. রব সালগেরো বলেন, ‘খাবার, আশ্রয়, নির্মাণসামগ্রী—এর সবই আমরা পাই উদ্ভিদের কাছ থেকে। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, কার্বন নিরূপণ, অক্সিজেন সৃষ্টি, এমনকি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও নির্ভর করতে হয় উদ্ভিদের ওপর।’

তাই আসুুন, সবাই মিলে সুস্থ, সুন্দর ও সবুজাভ পরিবেশ গড়ার লক্ষ্যে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণে উদ্যোগী হই। এতে আমরা রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে সওয়াবের ভাগীদার হব। তেমনি আমাদের পরিবেশও রক্ষা পাবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আপনার মতামত জানান