আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তিস্তা, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

প্রকাশিত



টাঙ্গাইলে কালিহাতী ও বাসাইল উপজেলায় গতকাল রবিবার বাঁধ ও সড়ক ভেঙে প্রায় ২০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে সড়কপথে যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। জেলার ভূঞাপুরে চরাঞ্চলের ফসলি জমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। যমুনা, ধলেশ্বরী, ঝিনাই, বংশাই, লৌহজংসহ বিভিন্ন নদীতে পানি বাড়ায় জেলার অন্য ৯ উপজেলার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হচ্ছে।

লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, খাগড়াছড়ি, জামালপুর ও রাজবাড়ীর অনেক এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খাগড়াছড়িতে পানিতে একজন ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছেন।

ফরিদপুরে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি ও টানা বৃষ্টিতে চরাঞ্চলের ২৬৪ হেক্টর জমির বাদামক্ষেত তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নীলফামারীতে দিনে উন্নতি, রাতে অবনতির মধ্যে দিয়ে চলছে তিস্তার বন্যা পরিস্থিতি।

কালিহাতীর আনালিয়াবাড়ী এলাকায় বাঁধ ও বাসাইলের আন্ধিরাপাড়া-বালিনা সড়কের বালিনা উত্তরপাড়া এলাকায় সড়কটি গতকাল ভেঙে যায়। স্থানীয়রা জানায়, দুই দিন ধরে আন্ধিরাপাড়া-বালিনা সড়কের বালিনা উত্তরপাড়া এলাকার সড়কটির ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। পরে অতিরিক্ত স্রোতের কারণে সড়কটি ভেঙে যায়। গতকাল সকালে আন্ধিরাপাড়ায় আরো তিনটি স্থানে সড়ক ভেঙে যায়। দুই দিনে প্রবল বেগে পানি ঢুকে উপজেলার বালিনা, আন্ধিরাপাড়া, আদাজান, কাঞ্চনপুর, কোদালিয়াপাড়াসহ কয়েকটি এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

যমুনা নদীর স্রোতের কারণে পাড় ধসের সঙ্গে চলছে ভাঙন। এতে গৃহহীন হচ্ছে মানুষ। জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, যমুনা ও ঝিনাই নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলায় বড় বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহ্সানুল বাশার জানান, বন্যায় যমুনার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে।

ভূঞাপুরে ১৯ গ্রাম প্লাবিত

ভূঞাপুরে যমুনার পানি বাড়ায় গাবসারা ইউনিয়নের পুরো চরাঞ্চল, অর্জুনা ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম ও নিকরাইল ইউনিয়নের চার-পাঁচ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৩৫০ হেক্টর জমির পাট, ১৭০ হেক্টর জমির তিল, ৮০ হেক্টর জমির শাক-সবজি, ১০ হেক্টর জমির বোনা আউশ তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি।

খাগড়াছড়িতে নিখোঁজ

খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি দুই কূল উপচে প্লাবিত হচ্ছে নিচু এলাকাগুলো। গতকাল দুপুরে শান্তিনগরের চেঙ্গী নদীতে লাকড়ি ধরতে গিয়ে বানের পানিতে ভেসে যান আরিফুল ইসলাম (২০)। তিনি শহরের শব্দ মিয়া পাড়ার তাজুল ইসলামের ছেলে। এদিকে শহরের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। পৌর মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী জানিয়েছেন, সদর উপজেলা মোট ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

কুড়িগ্রামে পানিবন্দি আড়াই লাখ মানুষ

দ্রুতগতিতে নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। রবিবার বিকেলে সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপত্সীমার ৩১ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপত্সীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ৪৯টি ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক চরের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রৌমারী উপজেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি। তলিয়ে গেছে বেশ কিছু পাকা সড়ক। প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক দপ্তরে ও প্রতিটি উপজেলায় কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও আইন-শৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৩৬১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এদিকে নাগেশ্বরী উপজেলার মুড়িয়ারহাট এলাকায় শুক্রবার দুধকুমার নদের একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে নতুন করে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উলিপুর উপজেলার মশালের চরের ২০০টি পরিবারের সবার বাড়িতেই পানি উঠেছে। সড়ক ও ফসলের ক্ষেত পানির নিচে। কুড়িগ্রাম পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলায় আরো পানি বাড়বে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো মেরামতের কাজ চলছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কালিপদ রায় জানান, চলতি বন্যায় এখন পর্যন্ত ৫৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে ৭৪২টি পুকুরের ৭০৫ জন মাছ চাষির ১১৫ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে।

রৌমারীর ইউএনও আশরাফুল আলম রাসেল জানিয়েছে, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নই এখন বন্যাকবলিত। সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ রৌমারী-ইজলামারী সড়ক নিমজ্জিত থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রৌমারী শুল্ক স্টেমন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন ৩১৩ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৪ লাখ টাকা, পশুখাদ্য বাবদ ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, শিশুখাদ্য বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে। ত্রাণ বিতরণ চলছে।

দিনে উন্নতি রাতে অবনতি

নীলফামারীর ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে রবিবার সকাল ৬টায় নদীর পানি বিপত্সীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় ছিল বিপত্সীমার পাঁচ সেন্টিমিটার নিচে। বাড়িঘরে পানি ওঠা-নামা করায় ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের চার সহস্রাধিক পরিবারের ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবন। ইিউএনও বেলায়েত হোসেন বলেন, তিস্তায় বন্যাদুর্গত টেপাখড়িবাড়ীর ১৫০ পরিবারে ২০ কেজি করে চাল ও বিভিন্ন এলাকায় ৩০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তিস্তা

লালমনিরহাট জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, গতকাল সকাল ৬টায় ফুলবাড়ীর শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপত্সীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বাড়ায় জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ও সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের তীরবর্তী কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা তীরবর্তী এলাকার মানুষ বন্যার আতঙ্কে আছে। জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, ‘দুই নদীর নিম্নাঞ্চলের ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি। তাদের জন্য ১৫০ মেট্রিক টন চাল ও ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ’

জামালপুরে ৩০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে যমুনা নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করায় জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। চরাঞ্চলসহ যমুনাপারের চারটি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিচু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকছে। আবাদি জমি তলিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় বন্যায় প্লাবিত একটি গুচ্ছগ্রামের ৯০টি পরিবার উপজেলা সদরের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। সরিষাবাড়ী উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের শিশুয়া-বাঘমারা রাস্তার ৪৮০ মিটার দীর্ঘ সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে বন্যার পানি ঢুকছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও অবনতি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পানিতে গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নাসিরনগরে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রায় চার ফুট পানি বেড়েছে। এতে প্রায় চার হাজার হেক্টর বোনা আমন ফসলি জমি, পাঁচ হাজার হেক্টর পাটক্ষেত ও মৌসুমি শাক-সবজির জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া শনিবার রাতে পানির তোড়ে উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় কয়েকটি এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদর, ভলাকুট ও ফান্দাউক ইউনিয়নের তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি ঢুকে পড়ায় বাসিন্দারা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ক্ষতির মুখে কৃষক

ফরিদপুর সদরের পদ্মা নদী অববাহিকার নর্থচ্যানেল, চরমাধবদিয়া এবং ডিক্রিরচর ইউনিয়নের চরাঞ্চলে বাদাম চাষ করা কয়েক শ কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্লাবিত হওয়ায়। এ ছাড়া জেলার পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদের পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। পাঁচ দিন ধরে উজান থেকে আসা ঢল ও অতি বৃষ্টিতে রাজবাড়ীর পাংশা, বালিয়াকান্দি, সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মায় পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলের কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি (বাদাম, তিল, পাট ইত্যাদি) ডুবে গেছে।

গাইবান্ধা জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়াসহ সব কয়টি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ফলে লোকজন বন্যা আতঙ্কে রয়েছে। অন্যদিকে উজান থেকে আসা ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে প্লাবিত হয়েছে তিস্তা, যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের চরসহ ও নিম্নাঞ্চল। ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। যমুনায় পানি বাড়ায় রবিবার দুপুরে সাঘাটার দক্ষিণ উল্যা গ্রামে শ্মশানঘাট সড়কটির বেশির ভাগ অংশ ভেঙে যায়।

৪০০ পরিবারের বাড়িতে পানি

সিরাজগঞ্জের খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের গুণেরগাতি, ছোট গুণেরগাতি ও খোকসাবাড়ী কারিগরপাড়া এলাকার চার শতাধিক পরিবারের বাড়িতে পানি উঠেছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]
তথ্যসুত্র: কালের কন্ঠ

আপনার মতামত জানান