হারিয়ে যাচ্ছে নদীমাতৃক দেশের অনুপম অনুষঙ্গ পাল তোলা নৌকা

প্রকাশিত



কবি জীবনানন্দ দাস বাংলার প্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘শরৎ যেন ভেসে উঠে অপরূপ রূপে। আজি কি তোমার মধুর মুরতি হেরিনো শারদ প্রভাতে! হে মাত বজ্র শ্যামল অঙ্গ ঝলিচে অমল সুভাতে। আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশটি প্রকৃতির অপূর্ব লীলা নিকেতন। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীতে বাংলার প্রকৃতির বন্দনা করেছেন। সৌন্দর্যের আধার আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বছরের একেক সময় একেক রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়ে থাকে। তেমনি আমাদের মাঝে হাজির হয় নবরূপে শরৎ কাল।

শুভ্র মেঘের দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে সাদা ও নীলের ভেলা বিমোহিত করে আমাদের। প্রকৃতির বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে শরতকে কাছে পাবার তাড়না সবার মাঝে বিরাজ করে। শরতের দিগন্তজোড়া মাঠে সাদা কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যেতে মন চায় প্রকৃতিপ্রেমীর। মাঝি-মাল্লাদের মনে লাল- সবুজের পালতোলা নৌকাসহ মাঝ নদীতে আনন্দ জাগায় শরতে।
বর্ষা-শরতের অপার শোভায় বিমোহিত হয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলী ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলী, শরৎ তোমার শিশির ধোয়ার কু-লে বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলে …..’।
বাঙালী জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে নদী কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আধুনিক যানবাহনের বহুল প্রচলনের আগে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল নদী আর নৌকা। যুগের হাওয়া লেগেছিল পালে, দ্রুত থেকে দ্রুততর ছুটতে হবে আমাদের। তাই দ্রুত ছুটে যাচ্ছি আমরা মৃত্যুর দিকে, ধারণ করে চলছি যান্ত্রিক সভ্যতা। তাই পাল তোলা নৌকাতে এখন আর আমাদের চলে না। ইঞ্জিন চালিত নৌকা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়ায় পরিবেশ মরে যাচ্ছে, এতে আমাদের সন্তানেরা পাবে বিষাক্ত পরিবেশ। বর্তমানে কালেভদ্রে দেখা মিলে পাল তোলা নৌকার।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, গানে, উপন্যাসে বাংলার প্রকৃতির সবকিছুই ফুটে উঠে। কবিগুরু তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যে বর্ণনা দিয়েছেন বাংলার প্রকৃতির সেই রূপ চিরন্তন হয়ে আছে। বর্ষা-শরৎ প্রকৃতি মানব হৃদয়ে রোমান্টিকতার যে সুর তুলে ধরে তা অন্য কোন ঋতুতে মিলে না। বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর যতই পরিবর্তন হোক বাংলার ষড়ঋতুর হেরফের হতে পারে। কিন্তু বৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসতে এখনও অনেক দেরি।

এই সময়টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে চোখ পড়ে নদের দিকে উত্তাল ঢেউ নেই, নদীতে জলরাশির স্তব্ধতা আকাশ একটু মেঘলা হলেই ঢেউ নেচে উঠে। কোথাও সামান্য সবুজ কোথাও নদীর কিনার ঘেঁষে কাশফুল। যখন নৌকা বয়ে যায় তখন মাঝিদের সঙ্গে যাত্রীরা অনুভব করে অনাবিল সুখ। এই সময়ে প্রকৃতির বাতাস এসে দোল খায় পাল তোলা নৌকায়। একটা সময় নদীর কিনারা দিয়ে গুনটানা (দড়ি) নৌকা চলত এখন আর তা চোখে পড়ে না।

বাতাসের অনুকূলে যাওয়ার জন্য বড় কাপড় দিয়ে আটকানো হতো পাল তোলা নৌকা। আজকাল তাও কমে গেছে। নৌকার পালকে কোন কোন এলাকায় বলা হয়ে থাকে বাদাম। যার নৌকা যত বড় বাদাম থাকত সেই মাপে। নৌকা বাতাসের গতির সঙ্গে জুড়ে চলত। নদী আর নৌকা ছিল আমাদের গ্রাম জীবনের বহমানতা।

বাংলাদেশের এমন অনেক এলাকা রয়েছে আজও, যেখানে মানুষের চলাচলে নৌকা ছাড়া চলে না। কিন্তু এ বাহনটির ইতিহাস কী তাও কেউ জানে না। তবে নৌকার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগে¦দে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে পরিচিত নৌকার নাম হচ্ছে ডিঙ্গি। নদীর তীরে যারা বসবাস করেন তারা সকলেই এই নৌকাটি ব্যবহার করেন নদী পারাপার বা অন্যান্য কাজে। আকারে ছোট বলে এই নৌকাটি চালাতে একজন মাঝিই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে এতে পালও লাগানো হয়।

সিন্ধু সভ্যতার সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা রকমের নৌকার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরে বহু দাঁড় বিশিষ্ট নৌকা দেখা যেত। নৌকায় দাঁড় টানার কাজে ব্যবহার করা হতো ক্রীতদাসদের। দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়া অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও কষ্টকর। পালের উদ্ভাবন এ অবস্থা থেকে মানুষকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছে। দাঁড় টানার সঙ্গে পাল টানানো হলে নৌকার গতি বেড়ে যায় এবং হাওয়ার গতিতে নৌকা আরও বেশি বেগবান হয়। তখন থেকেই নানা ধরনের পালের ব্যবহার শুরু হয় বাতাসের শক্তি কাজে লাগানোর জন্য ।

বাংলার বারভুঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর একটা বিরাট বহর ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে বাংলা থেকে নওয়াবদের বিতাড়িত করে রণতরীর সাহায্যে। বিক্রমপুরের কাছে নৌ যুদ্ধে মান সিংহের নৌ বহরের উপর ঈশা খাঁর চূড়ান্ত বিজয় ষোড়শ শতকে বাংলার নৌ শক্তির একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পাল তোলা নৌকার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে। নদীতে মাঝে মধ্যে পালের নৌকা দেখা মেলে। পাল তোলা নৌকা চলাচলের দৃশ্য এখন বিরল, এটি এখন কেবলই স্মৃতি।

আপনার মতামত জানান