মুমিনের করণীয়

প্রকাশিত



মানবজীবনে নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনিরাপদ জীবন মানুষের মধ্যে নৈরাশ্য তৈরি করে এবং তাদের কর্মস্পৃহা ধ্বংস করে। নিরাপত্তাহীনতা সামাজিক শৃঙ্খলাও নষ্ট করে। প্রাচীন কাল থেকেই নিরাপত্তা মানুষের প্রার্থিত বিষয়।

যেমন—ইবরাহিম (আ.) নিজ পরিবারের জন্য দোয়া করেছিলেন, ‘স্মরণ করো, যখন ইবরাহিম বলেছিলেন, হে আমার প্রতিপালক! এটাকে (মক্কা) নিরাপদ শহর করো এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা প্রদান করো। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৬)

উল্লিখিত আয়াতে ইবরাহিম (আ.) জীবিকার আগেই নিরাপত্তার দোয়া করেছেন, যা দ্বারা নিরাপদ জীবন লাভের গুরুত্ব প্রকাশ পায়।

নিরাপদ জীবন আল্লাহর অনুগ্রহ : মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিরাপদ জীবনকে তাঁর অনুগ্রহ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানি হয় আমার দেওয়া জীবিকাস্বরূপ? কিন্তু তাদের বেশির ভাগই জানে না। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৭)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ করো, তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে। তোমরা আশঙ্কা করতে যে লোকেরা তোমাদের আকস্মিকভাবে ধরে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদের শক্তিশালী করেন এবং তোমাদেরকে উত্তম বস্তুগুলো জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও। ’

(সুরা : আনফাল, আয়াত : ২৬)

নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশা : প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত সবাই নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশা করে এবং এর দ্বারাই তারা আশ্বস্ত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা যখন ইউসুফের কাছে উপস্থিত হলো, তখন সে তার মা-বাবাকে আলিঙ্গন করল এবং বলল, আপনারা আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে প্রবেশ করুন। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯৯)

নিরাপদ জীবনের সঙ্গে পরকালের সম্পর্ক : পার্থিব জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে পরকালীন জীবনের নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। কেননা পার্থিব জীবন যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে মানুষ ইবাদত-বন্দেগিতে মনস্থির করতে পারে না। এ জন্য আল্লাহ নিরাপদে ইবাদতের সুযোগকে অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রাসুলকে স্বপ্নটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে—তোমাদের কেউ কেউ মস্তক মুণ্ডিত করবে আর কেউ কেউ কেশ কর্তন করবে। তোমাদের কোনো ভয় থাকবে না। আল্লাহ জানেন তোমরা যা জানো না। এটা ছাড়াও তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এক সদ্য বিজয়। ’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৭)

এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে লোক পরিবার-পরিজনসহ নিরাপদে সকালে উপনীত হয়, সুস্থ শরীরে দিনাতিপাত করে এবং তার কাছে সারা দিনের খোরাকি থাকে, তাহলে তার জন্য যেন গোটা দুনিয়াটাই একত্র করা হলো। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৬)

নিরাপদ জীবন লাভের উপায়

মানুষ কেবল তার নিজের প্রচেষ্টায় নিরাপদ থাকতে পারে না, আল্লাহর অনুগ্রহের প্রয়োজন হয়। কেননা নিরাপত্তা মহান আল্লাহরই দান। আল্লাহর কাছ থেকে নিরাপদ জীবন লাভের কিছু উপায় হলো—

১. কৃতজ্ঞতা আদায় : জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা লাভের জন্য মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা অপরিহার্য। অকৃতজ্ঞ জীবন মানুষকে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সাবাবাসীদের জন্য তাদের বাসভূমিতে ছিল এক নিদর্শন : দুইটি উদ্যান, একটি ডান দিকে ও অপরটি বাম দিকে। তাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক প্রদত্ত জীবিকা ভোগ করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। উত্তম নগরী এবং ক্ষমাশীল প্রতিপালক। পরে তারা অবাধ্য হলো। ফলে আমি তাদের ওপর প্রবাহিত করলাম বাঁধভাঙা বন্যা এবং তাদের উদ্যান দুটিকে পরিবর্তন করে দিলাম এমন দুটি উদ্যানে, যাতে উৎপন্ন হয় বিস্বাদ ফলমূল, ঝাউগাছ এবং কিছু কুলগাছ। ’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১৫-১৬)

২. নিষ্কলুষ বিশ্বাস : আল্লাহর প্রতি নিষ্কলুষ বিশ্বাস তথা খাঁটি ঈমান মানুষের জীবনকে নিরাপদ করে। এটা মহান আল্লাহর অঙ্গীকার। তিনি বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৮২)

৩. আল্লাহর আইনে বিচার করা : রাষ্ট্রপ্রধান ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যখন আল্লাহর আইন বাস্তবায়নে কঠোর হবে, তখন সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,‘যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪০১৯)

৪. অন্যায়ের প্রতিবাদ করা : কোনো সমাজে ভালো কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করার চর্চা না থাকলে সেই সমাজে দ্রুত বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে এবং সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে উপদেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হয়, তখন যারা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করত তাদেরকে আমি উদ্ধার করি এবং যারা অবিচার করে তারা কুফরি করত বলে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিই। ’

(সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৬৫)

৫. দোয়া করা : নিরাপদ জীবন লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদ জীবনের জন্য দোয়া করতেন। হাদিসে এসেছে, ‘নতুন চাঁদ দেখার পর নবী (সা.) বলতেন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য চাঁদটিকে বরকত, ঈমান, নিরাপত্তা ও শান্তির বাহন করে উদিত করুন। হে নতুন চাঁদ, আল্লাহ তাআলা আমারও প্রভু, তোমারও প্রভু। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫১)

পরকালীন জীবনের নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ : একজন মুমিনের কাছে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তাই শুধু নিরাপত্তা নয়, ঈমান-ইসলামের নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ কে—যে ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সে, না যে কিয়ামতের দিন নিরাপদে থাকবে সে? তোমরা যা ইচ্ছা করো, তোমরা যা করো তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা। ’ (সুরা : হা-মিম-সাজদা, আয়াত : ৪০)

আল্লাহ সবাইকে নিরাপদ জীবন দান করুন। আমিন।

আপনার মতামত জানান