পেলের অনন্ত নক্ষত্রে যাত্রা

প্রকাশিত



মৃত্যু অমোঘ। এই পরিণতি এড়ানোর উপায় নেই। তা সে যতই প্রাচুর্যশালী হোক না কেন। অনন্তলোকের ডাক কার, কখন আসবে তা কেবল ঈশ্বরই জানেন। তবে পেলের ক্ষেত্রে বিষয়টা মনে হয় অন্যরকম। কিছু সময়ের জন্য হলেও মৃত্যুকে যেন তিনি এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। কাতার বিশ্বকাপের সময় তো হয়েছিল যমে-মানুষে টানাটানি। বিশ্বকাপ যাকে দিয়েছে অমরত্ব, সেই তিনি কি পারেন এর অভাবনীয় আনন্দে জল ঢেলে দিতে? তাই সেবারের লড়াইয়ে জিতেছিলেন কালো মানিক। সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রাণভরে উপভোগ করেছেন বিশ্বকাপ। দেখেছেন নিজ দল ব্রাজিলের লক্ষ্যপূরণের আগেই বিদায়ের পরিণতি। তাতে ব্যথিত হয়েছেন। আবার প্রিয় লিওনেল মেসির হাতে শিরোপাটা দেখে উদ্বেলিতও হয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বর পর্দা নামে অবিস্মরণীয় এক বিশ্বকাপের। পেলেও আর বেশি সময় নেনি। ব্রাজিলকে তিনটি বিশ্বকাপ জেতানো ফুটবল জাদুকর শুরু করেছেন অনন্তলোকে যাত্রা।

বয়স হয়েছিল ৮২। তবে হাসিতে কখনই ছিল না বার্ধক্যের ছাপ। এমনকি শরীরে বাসা বাঁধা নানা ব্যাধিও সেই হাসিটা মুছে দিতে পারেনি। কদিন পরপরই মায়াবী হাসির পেলের ছবি ভেসে বেড়িয়েছে অন্তর্জালে। তাতে আশ্বস্ত হয়েছি। কাতারে বিশ্বকাপ চলাকালে একবারও মনে হয়নি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তবে নানা রোগে মাঝেমধ্যেই কাবু হয়ে পড়তেন শেষ দুবছর। কিডনি, প্রোস্টেট জটিলতার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছিল কোলন ক্যানসার। নিয়মিত চলছিল কেমোথেরাপি। বিশ্বকাপ চলাকালে শরীরে কেমো কাজ না করায় তাকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। কাতার বিশ্বকাপের ফুটবল উন্মাদনার মাঝেও হাজারো ফুটবলপ্রেমীর মনে ছিল তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা। খোদ ব্রাজিল দলের কোচ-ফুটবলাররা অনেকবার পেলের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছেন। খেলার আগে-পরে। দক্ষিণ কোরিয়াকে উড়িয়ে দ্বিতীয় পর্ব পেরিয়ে যাওয়া ম্যাচ শেষে নেইমাররা পেলের বিশাল প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর সবুজ গালিচা জুড়ে। দূর থেকে জানিয়েছিলেন শুভ কামনা। এর তিন দিন পর ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে দুঃখজনক বিদায় বরণ করতে হয় পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। সেই হারে ব্যথিত হয়েছিলেন মৃত্যুর সঙ্গে জোর লড়াই চালিয়ে যাওয়া পেলে। দূর থেকে তিনিও নেইমারদের উদ্দেশে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন সান্ত্বনাবাণী। কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিল অধ্যায় শেষের পর পেলে নিজেও খুব করে চেয়েছিলেন, শিরোপাটা উঠুক আর্জেন্টাইন মহানায়ক লিওনেল মেসির হাতে। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল জিতে স্বপ্নের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন বাঁ-পায়ের জাদুকর। ফুটবলীয় বৈরিতা ভুলে পেলে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছিলেন মেসির উদ্দেশে। সে যাত্রায় কিছুটা সেরে ওঠায় খুব মনে হচ্ছিল আরও কিছুদিন বনস্পতির ছায়া দিয়ে যাবেন গোটা ফুটবল দুনিয়াকে। কিন্তু তা আর হলো কই? কাল গভীর রাতে তার মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেলের মৃত্যুসংবাদ জানান বিশ্ববাসীকে।

হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষও নিশ্চিত করেছে এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তোর মৃত্যু, ‘শরীরের নানা অঙ্গ বিকল হয়ে পড়তে শুরু করে, তখনই বোঝা যাচ্ছিল শরীরে বাসা বাঁধা কোলন ক্যানসারে বিস্তৃতি বেড়েই চলছিল। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে হতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’পেলের অফিশিয়াল টুইটারে করা একটি পোস্টও নিশ্চিত করে রাজার বিদায়ের ব্যাপারটি।

ছিল সুদীর্ঘ ২১ বছরের ক্যারিয়ার। এই সময়টা যেসব কীর্তি গড়েছিলেন, তা মনে হয়নি অন্য কেউ ভাঙতে পারবে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে খেলা ১৩৬৩ ম্যাচে করেছেন অবিশ্বাস্য ১২৮১ গোল! সেটিও আবার ভিএআরহীন, ফরোয়ার্ডদের সামলে রাখার যুগের আগে! ব্রাজিলের জার্সিতে খেলা ৯২ ম্যাচে করেছিলেন ৭৭ গোল। যেটা বিশ্বকাপের ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল নেইমারের। হয়তো কিংবদন্তিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতেই ছাড়িয়ে যাননি পিএসজি তারকা। তবে ছুঁয়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার সন্ধ্যায়। গোলে পেলেকে ছুঁয়ে ফেললেও কীর্তিতে কোনোভাবেই কিংবদন্তির সমকক্ষ হতে পারেননি নেইমার। দুনিয়ায় পেলেই একমাত্র ফুটবল খেলোয়াড়, যার আছে তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য অভিজ্ঞতা।

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তার তারকাখ্যতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। ১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিস্ফোরিত হয়ে ব্রাজিলকে এনে দেন কাক্সিক্ষত শিরোপা। কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল দিয়ে নজর কাড়া শুরু। সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে অসাধারণ হ্যাটট্রিকের পর ফাইনালে স্বাগতিক সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারানোর ম্যাচে করেন জোড়া গোল। এমন গোল বিস্ফোরণের পরপরই হইচই পড়ে গিয়েছিল সদ্য কৈশোর পেরুনো পেলেকে নিয়ে। তবে তার প্রতিভার প্রথম প্রকাশ ব্রাজিল অভিষেকের দুবছর আগে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে সান্তোসের হয়ে। ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের দাবি, তাদের জার্সিতে ১৯ বছরে পেলের গোলসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে হাজারেরও বেশি। ১৯৬৫ বিশ্বকাপে পেলে খেলেন ২১ বছর বয়সে। আরও পরিণত হয়ে। তবে মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ২-০ গোলের জয়ে অবদান রাখার পর চোটের কারণে পরের ম্যাচগুলো খেলতে পারেননি। তবে সাইডলাইন থেকে ঠিকই দেখেছেন নিজ দলকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিততে। সর্বশেষ ১৯৭০ বিশ্বকাপটা নিজের করে নিয়েছিলেন পেলে। ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারানোর ম্যাচে গোলোৎসবের শুরুটাই করেছিলেন তিনি।

কাতার বিশ্বকাপের পর বিশ্বের একটা বড় অংশই মেনে নিচ্ছেন পেলে-ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে সেরার আসনটা এখন লিওনেল মেসির। ব্রাজিলিয়ানরা অবশ্য এটা মেনে নিতে পারছেন না। তাদের কাছে তাদের অতিপ্রিয় পেলেই সেরা। ২০২০ সালে বিবিসির এক জরিপে দেখা গিয়েছিল সেরার মাপকাঠিতে তিনি পেছনে ফেলেছিলেন মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, দিয়েগো ম্যারাডোনা ও জোহান ক্রুইফকে। এই বিশ্বকাপের পর হয়তো এই জরিপের হিসাবটা পাল্টে যাবে, তবে অসামান্য সব কীর্তিই পেলেকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।



পেলে ১৯৪০ – ∞

• একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জয় (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০)

• রেকর্ড ১৩৬৬ ম্যাচে ১২৮১ গোল

• ব্রাজিলের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল (যৌথ সর্বোচ্চ নেইমার)

• ফিফা প্লেয়ার অব দ্য সেঞ্চুরি

• বিশ্বকাপে ১৪ ম্যাচে ১২ গোল

• ফিফা বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড় ১৯৫৮

• কোপা আমেরিকা সেরা খেলোয়াড় ও সেরা গোলদাতা (১৯৫৯)

• দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলার (১৯৭৩)

• আন্তর্জাতিক ফুটবল হল অব ফেম

কিন্তু এসব কোনো রেকর্ডই পেলেকে বোঝাতে যথেষ্ট নয়। তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে …

আপনার মতামত জানান