নজরুল চেতনায় বিশ্বনবী (সা.)

প্রকাশিত

কবি যে যুগে যুগে সত্যের গীতি, কল্যাণের গীতি, বিরাট অনন্ত মহাজীবনের নিগুঢ় ভিত্তি কর্মের উদ্বোধন গীতি গেয়ে এসেছেন। যার মৃদু আঘাতে প্রাণের বীণারতারে নীরব সহসা আকুলরাগিনী ঝন্ধার জেগে উঠে মানব দেহের স্নায়ুর পরতে পরতে উম্মাদনার তড়িৎ প্রবাহ ছুটিয়ে দেয়। তিনি সেই কবিদের অন্যতম প্রেমের, বিদ্রোহী, বিশ্ববরেণ্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একজন। তাঁর কণ্ঠে সঞ্জীবনীসুধার উম্মাদনা আছে।



বাংলা সাহিত্যে তাঁর আগমন এমন এক সময়ে যখন রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, সত্যেন্দ্রনাথ, বন্ধিমচন্দ্রদের জয় জয়কার। বাংলা সাহিত্য ছিল এদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শে সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের আগমন ছিল ধূমকেতুর মতোই একটি নতুন ধূমকেতু। তাঁর কলমযুদ্ধ নিমিষেই বাংলা সাহিত্যের চেহারা পাল্টিয়ে দিয়েছে। যে সাহিত্যে একদিন ইসলাম ও মুসলমানদের স্থান ছিল না, তা এ সময় হয়ে উঠল এক অভিনব খোদায়ী ভাবধারায় উজ্জ্বীবিত। মানবতা, সাম্য, মৈত্রী, শান্তির সুবাতাস বইতে লাগল সাহিত্যে। কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমানদের লক্ষ্য করে আহবান করলেন-

দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে

দ্বীন-ই-ইসলামী লাল মশাল

ওরে বেখবর, তুই উঠ জেগে

তুই ও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল।

ঘুমন্ত এবং অবহেলিত মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছিলো সেদিন তাঁর কবিতা। তিনি বেখবর মুসলমানদের উজ্জ্বীবিত করতে স্মরণ করিয়ে দেন আল কোরআন ও বিশ্বনবীর আদর্শের কথা-

অন্যের দাস করিতে কিংবা নিজে দাস হতে ওরে

আসেনি দুনিয়ায় মুসলিম, ভুলিলে কেমন করে

ভাঙ্গিতে সব কারাগার, সব বন্ধন ভয় লাজ

এল যে কোরান, এলেন যে নবী, ভুলিলে সে সব আজ।

তাঁর কবিতা,গান, প্রবন্ধ, গজলগুলো তখন যে ভাবে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল তেমনি এগুলো আছে। নজরুল ইসলামের আহবানগুলো সর্বকালের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ ইসলামী অবদানের দাবীদার। তাঁর জিহাদী ডাক আজো সুপ্তমুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গাতে পারে-

ওরে আয়

ঐ ইসলাম ডুবে যায়।

‘ঐ ইসলাম’ বলতে আগেরকার নবীদের ইসলাম নয় বা বর্তমানের মি. মওদুদী, ইলিয়াছি, তাইমিয়া, নজদী ইসলাম ও নয়। কবি বুঝাতে চেয়েছেন ‘মুহাম্মদী ইসলাম’ অর্থাৎ বিশ্বনবীকে। শিল্পীর গুন বিকশিত হয় শিল্পকর্মের মাধ্যমে। আমরা সকলেই জানি যে কর্তার আদেশই কর্ম। যদি কর্তারই অস্থিত্ব না থাকে, তাহলে কর্ম কী করে হবে? নিচের চরণগুলোতে আমরা ব্যাখ্যাটির আরো স্পষ্ট হতে পারব। কবি বলেন-

আমি বুঝিনা ক কোন ইজম

কোন রূপ রাজনীতি

আমি শুধু জানি আমি শুধু মানি

এক আল্লাহর প্রীতি।

তার শক্তিতে জয়ী, হবে লয়ে আল্লার নাম, জাগো

ঘুমায়োনা আর, যতটুকু পার শুধু তার কাজে লাগো।

ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা তারা শয়তানী ঢেলা

আর বেশি দিন নাই, শেষ হয়ে এসেছে ওদের খেলা।

‘ভেদ বিভেদের… চেলা’ এ চরণে কবি বুঝাতে চেয়েছেন, শয়তান হযরত আদম আলাইহিস সালাম কে তার সাথে মিল দেখাতে গিয়ে ছোট-বড়, আগুন মাটি ভেদাভেদ করে হয়েছে মালয়ুন বা শয়তান, আর এখন যারা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে নিয়ে নূর-মাটি, ছোট-বড়, আমার মত ভেদাভেদ করে তারা শয়তানের চেলা।



নবী প্রেমিক নজরুল তাঁর প্রেমের বহ্নিশিখা জ্বালিয়েছেন কবিতার ছন্দে, গীতের সুরে, বীণার তারে, মানবতার কণ্ঠসুরে, কবি খোদ নিজেই নবীকে ‘নুরনবী’ হিসেবে সম্বোধন করে ক্ষান্ত হননি, নবীর পদ ধূলায় নিজেকে ধন্য করার জন্য আপনার শরীরকে লালগালিচা বানিয়ে দিয়েছেন-

আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ

এই পথে মোর চলে যেতেন নুরনবী হযরত।

ভেদাভেদ করে তারা কারা? সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের ‘মানুষ’ কবিতায় কবি তাদের বর্ণচোরা রূপটি চিত্রিত করেছেন-

তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ডগাহে সার্থের জয়!

মানুষেরে ঘৃণা করি,

ও’কা’রা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি,

ও’মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।

পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!

মসজিদে কাল শিরণী আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি

বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি।

আশেকের পূর্ণত্ব তো মাশুকের মিলনই। আশেকে রসূল কবি আরো সহজ করে বলেন-

তর্ক করে দুঃখ ছাড়া কী পেয়েছিস অবিশ্বাসী

কী পাওয়া যায় দেখনা বারেক হযরতে মোর ভালবাসি।

এখানে ‘ অবিশ্বাসী’ বলতে কাফের, মুশরিক, বিধর্মী নয়। এক শ্রেণীর মোল্লা মুসলমানদের বুঝানো হয়েছে ‘ভালবাসি’ শব্দটি দ্বারা। কবি মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’কে পালন করেছেন তাঁর কবিতার গীতের সুরে সুরে, আর জুলুস পালন করেছেন কবিতার ছন্দের তালে তালে

ত্রিভুবনে প্রিয় মুহাম্মদ এলরে দুনিয়ায়

আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়

ধূলির ধরা বেহেশত আজ, জয় করিল গেলরে লাজ

আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারা।

‘খুশির ঢল’ নেমেছে আরবি অনুবাদ করলে জসনে জুলুসই অর্থ দেয়। মুসলমানদের আনন্দ দু-ঈদের মধ্যেই কবি সীমাবদ্ধ রাখেন নি। নবীর আগমন নিত্য ঈদ হিসেবে অভিহিত করে বলেন-

এই দুনিয়ায় দিবা-রাত্রি

ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী।

ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামা কে মুসলমানদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে কবি আরো বলেন-

ইসলামের ঐ সওদা ল’য়ে এল নবীন সওদাগর।

বদনসীব আয়, আয়গুনাহগার, নতুন করে সওদা কর।।

জীবন ভরে করলি লোকসান আজ হিসাব তার খতিয়ে নে,

বিনিমূলে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহেশতী নজর।।

সাহারাতে ফুটলরে রঙীনগুলে লালা

সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা

চেনে রসিক ভোমরা বুলবুল সেই ফুলের ঠিকানা

কেউ বলে হযরত মোহাম্মদ কেউ বা কমলী ওয়ালা।

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে।

দু’জাহানের সম্রাট ছিলেন নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি। মহান স্রষ্টা তাঁকে দুনিয়ার রহমত স্বরুপ প্রেরণ করে ছিলেন। মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থের ফাতেহা-ই-দোয়াজ দহম’ কবিতায় এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। মহানবীর আবির্ভাবের ফলে সমস্ত অন্যায়, অবিচার, পাপাচার, অজ্ঞতা, অন্ধকার দূরীভূত হলো এবং সারাজাহান আলোকিত হলো ন্যায় ও সত্যের আলোয়। তাই আল্লাহর নবী এবং রসূল হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামা এর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁর নামের সাথে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ দরুদ পাঠ করা হয়। তারা কারা? সে ব্যাখ্যার ও একটি ইঙ্গিত আছে। কবি বলেন-

শোন্ দামাম কামান তামান সামান

নির্ঘোষি’ কার নাম

পড় ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লাম!

ভয়ে ভূমি চুমে ‘লাত্ মানাত’ এর ওয়ারেশীন।

‘ওয্যা হোবল’ ইবলিস, খারেজীন।

‘এয় শামসোজ্জ্বাহা বদরোদ্দাজা কামারোজ্জাঁমা সালাম!

তিনি আরো বলেন-

আজকে যত পাপী ও তাপী

সবগুনাহের পেল মাফি;

দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী জুলুম নিল বিদায়।

বুখারী শরীফে আবু লাহাব কর্তৃক নবীর মিলাদুন্নবীতে কৃতদাসী আজাদ এবং “ওমা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামীন” এ আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মরমী সাধক, আধ্যাত্মিক ও ইসলামী রেঁনেসার কবি। তিনি বলেন-

আমার মুহাম্মদের নামে ধেয়ান হৃদয়ে যার রয়

খোদার সাথে হয়েছে তার গোপন পরিচয়।

যে খোস নসীব গিয়াছে ঐ নামের স্রোতে ভেসে

জেনেছে সে কোরআন হাদিস ফেকা এক নিমিষে

মোর নবীজীর বর-মালা করেছে যার হৃদয় আলো,

বেহেশতের সে আশ রাখেনা, তার নাই দোজখের ভয়।

কবি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামা কে যে কত ভালবেসেছেন, তার প্রমাণ আমরা তাঁর কবিতার ছন্দের আক্ষরিক বিশ্লেষণ করলে তা দেখতে পাব।

‘আহমদের’ ঐ মিমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন

আহাদ সেথায় বিরাজ করে হেরে গুনীজন।

যে চিনতে পারে রয়না ঘরে, হয় সে উদাসী

রূহানী আয়নাতে দেখরে সে নুরী রওশন।।

তিনি আরবি অক্ষরে ‘আহমদ’ শব্দটি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এর চারটি হরফ থেকে (মিম) হরফটি বাদ দিলে শব্দটি হয় ‘আহাদ’। আর আহাদ হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ। যেমন- সূরা ইখলাছের প্রথম আয়াত- কুলহু আল্লাহু আহাদ, অর্থ আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। এই মিমই হচ্ছে গুপ্ত রহস্য। মিম পর্দাই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামা এর সুরতে বশরিয়ত বা মানবীয়রূপ। যা ‘আনা বাশারুমমিছলিকুম’ এর ব্যাখ্যা। আর যারা বলে হাশরের দিনে কেউ কারো সুপারিশ করবে না, এমনকি নবী মুহাম্মদ ও করতে পারবে না, তাদের জবাবে কবি বলেন-

শাফায়তের সাত রাজার ধন, কে নিবি আয়, ত্বরা কর।।

কিয়ামতের বাজারে ভাই মুনাফা যে চাও বহুৎ,

এই বেপারীর হও খরিদ্দার লওরে ইহার শীল মোহর।।

আরশ হ’তে পথ ভুলে এল মদিনা শহর,

নামে মোবারক মোহাম্মদ, পুঁজি ‘আল্লাহ আকবার’।।

রসূলের সুপারিশ পেতে হলে নবীকে গুরু, মুর্শিদ মানতে হবে, এবং সেই আয়াত ইন্নাল্লাজিনা ইউনাকা ইন্নামা ইউবা ইউনাল্লাহ অর্থ নিশ্চয়ই যারা আপনার কাছে বায়াত নেয়, তারা আল্লাহর কাছেই আনুগত্যের শপথ গ্রহন করে। (সূরা ফাতাহ) এর দিকে ইশারা করেন-

তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম

ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি, খোদায়ী-কালাম

ঐনামের দামন ধ’রে আছি- আমার কিসের ভয়

ঐ নামের গুনে পাবো আমি খোদার পরিচয়

তাঁর কদম মোবারক যে আমার বেহেশতী তান্জাম

মুর্দিশ মোহাম্মদের নাম।।

আল্লাহকে পেতে হলে রসূলের অছিলা চাইতে হবে। কবি বলেন-

আল্লাকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালবেসে

আরশ কুরসি লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।।

রসূল নামের রশি ধরে

যেতে হবে খোদার ঘরে।।

এ যেন ওবতাগু ‘ইলাইহিল অছিলা’ এর কাব্যিক অনুবাদ। এছাড়া কবি ভবনদী পার হওয়ার জন্য নবীকে সার মনে করেছেন-

আল্লা আল্লা বলরে ভাই নবী কর সার

মাজা দুলিয়ে পারিয়ে যাবে ভবনদী পার।

কবি তাঁর ‘ধূমকেতু’ গ্রন্থের মধ্যে বলেন, মানুষের মুখ উল্টে গেলে ভূত হয় বা ভূত হলে তার মুখ উল্টে যায়। কিন্তু মানুষের হৃদয় উল্টে গেলে সে যে ভূতের চেয়েও কত ভীষণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র হয়ে ওঠে তাও আমি ভাল করেই জানি। কবি বলেন-

বক্ষে আমার কা’বার ছবি চক্ষে মোহাম্মদ রসূল।

শিরোপরি মোর খোদার আরশ গাই তারি গান পথ-বেভুল।।

লায়লির প্রেমে মজনু পাগল, আমি পাগল ‘লা-ইলার’;

প্রেমিক দরবেশ আমায় চিনে, অরসিকে কয় বাতুল।।

ফতোয়া দিলাম-কাফের কাজীও

যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!

কবি বিশ্বনবীর মহিমা এভাবেই বর্ণনা করেন-

কেয়ামতে যার হাতে কওসর পিয়ালা

পাপে মগ্ন ধরা যাহার ফজিলতে ভাসিল সুমধুর তৌহিদ স্রোত

মহিমা যাহার জানেন এক আল্লাহ তালা।

কবির সাথে আমি অধম ও সুর মিলাতে চাই-

গোলামে মোস্তফা যারা

মরণে ভয় করেনা তারা

পুলকে পার হয়ি পুলসিরাত

অমরত্ম পাবে সুনিশ্চয় জান্নাত।

-মুহাম্মদ গোলাম মুস্তফা, শিক্ষক,লেখক ও গবেষক

তথ্য সূত্র:-

আল-কোরআন, আল-হাদিস, নজরুল রচনাবলী, নজরুল কাব্যবলী।

আপনার মতামত জানান