ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং যোগাযোগ
ঐতিহাসিক সোনারগাঁ শুধু কয়েকশ বছরের পুরানো স্মৃতি বিজড়িত ধ্বংসাবশেষ নগরীই নয়, এর সাথে জড়িত আছে একটি স্বাধীন জাতির আত্ম পরিচয়ের অনুভূতি। ইতিহাসের আবহমান ধারায় অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এ অনভূতি আরো সুদৃঢ় হয়েছে। সোনারগাঁ আজ এমন একটি নামে পরিণত হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতি একযোগে প্রকাশ পাচ্ছে।
সোনারগাঁ নামকরণের ইতিহাস রহস্যাবৃত। কারো কারো মতে, উপমহাদেশের একমাত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (সোনারগাঁ) থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রতিটি শিক্ষানবিস সেকালে স্বর্ণের টুকরো হিসাবে আখ্যায়িত হতেন এবং তাদের স্মরণে নামকরণ হয়েছিল সোনারগাঁ বা সুবর্ন গ্রাম। ডঃ নীহার রঞ্জন রায় তার বাঙ্গালার ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, প্রাচীন নিম্নবঙ্গে বা আশে পাশে কোন সোনার খনি ছিল। অথবা বুড়িগঙ্গার বা সুবর্ন গ্রামের পাশ্ববর্তী নদীগুলোতে সোনার গুঁড়ো ভেসে আসতো। এ স্বর্ণ প্রাপ্তির ফলে সুবর্ন গ্রাম বা সোনারগাঁ নামকরণ হতে পারে। কিংবদন্তী আছে যে, এখানে কোন এক সময় স্বর্ণের বৃষ্টি হয়েছিল এবং এর পর থেকে এ স্থানের নামকরণ হয়েছে সুবর্ন বা সোনারগাঁ। কথিত আছে, বাংলার বাঁর ভূইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সোনাবিবি। এই সোনাবিবি থেকেই সোনারগাঁ এর নাম করণ হয়েছে। সোনারগাঁ নামকরণের পেছনে উপরে উল্লিখিত তথ্যাবলির কোনটি সত্য তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ডঃ আর. সি. মজুমদার ও স্যার যদুনাথ সরকার যে সুবর্ণ ভূমির কথা বলেছেন তা এ সোনারগাঁ ভূমিকেই বুঝায়। যার মাটির বর্ণ সুবর্ণ বা রক্ত বর্ণ ছিল এবং যাকে সুবর্ণ ভুক্তি কিংবা সুবর্ণ বিষয় ও বলা হত। কালিকা পুরানে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র তীরের অনেক স্থানের ভূমি রক্তবর্ণ বলে উল্লেখ আছে। কথিত আছে যে, দেবা সুরের যুদ্ধকালে রক্তপাত হেতু মৃত্তিকা লোহিত বর্ণ ধারণ করেছিল। স্বর্ণ ভূমি থেকে সোনারগাঁ বা সুবর্ণ গ্রামের নাম করণ হতে পারে।
সোনারগাঁয়ের প্রাচীন ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। সোনারগাঁ বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। মধ্যযুগীয় নগরটির যথার্থ অবস্থান নির্দেশ করা কঠিন। বিক্ষিপ্ত নিদর্শনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি পূর্বে মেঘনা নদী , পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী, দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল।
শুর, পাল, সেন ও দেব রাজাদের আমলে গোড়াপত্তন হলেও সোনারগাঁয়ের সমৃদ্ধ এবং গৌরব উজ্জ্বল যুগের শুরু হয় ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমল থেকে। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সোনারগাঁ স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে পরিণত হয়। পরে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্, শের শাহ, ঈশা খাঁ পর্যায়ক্রমে সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেন।
সোনারগাঁ এককালে ব্যবসায়, শিক্ষা দীক্ষায়, কৃষি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও কারুকার্যে ছিল বিশ্বেরসেরা। সোনারগাঁয়ের মসলিন কাপড় ছিল সারা বিশ্বে সমাদৃত। কথিত যে, বাংলার প্রথম মসজিদ সোনারগাঁয়ের গোয়ালদী গ্রামে নির্মিত হয়, যা ইতিহাসে মুসলিম উম্মার স্বাক্ষও বহন করছে। সোনারগাঁ হতে পাঞ্জাব পর্যন্ত পৃথিবীর দীর্ঘতম সড়ক, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড শের শাহের আমলে নির্মিত হয়। এখানে রয়েছে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ এর মাজার, শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রঃ) এর মাজার, হযরত দানেসমান্দ (রঃ), লালপুরীর মাজার, পাঁচ পীরের দরগাহ্ ও আয়নাল শাহ্ দরগাহসহ অসংখ্য গুনীজনের স্মৃতি।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী ও মসলিনের শহর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলাকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড কমিউনিকেটরস কাউন্সিল (ডব্লিউসিসি) বিশ্ব কারুশিল্প শহরের মর্যাদা প্রদান করে। ফলে বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো স্থান বিশ্ব কারুশিল্প শহরের মর্যাদা পেল। এতে ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ের কারুশিল্পের সৌন্দর্য, সুনাম ও কৃতিত্ব বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই স্বীকৃতির ফলে ভারতের মহাবলিপুরম (পাথর খোদাই) ও জয়পুর (গহনা), চীনের ফুশিন (অ্যাগেট), থাইল্যান্ডের সাখন নাখন (ইন্ডিগোডাই), ডেনমার্কের বর্নহোম (সিরামিক), ইরানের কারপোরগান (মৃৎশিল্প) ও ইসফাহানসহ বিশ্বের অন্যান্য কারুশিল্প শহরের সঙ্গে সহযোগিতা, অংশীদারত্ব ও বিনিময়ের সুযোগ পাবে সোনারগাঁ।
সোনারগাঁয়ের আকর্ষনীয় পর্যটন অঞ্চল পানাম সিটি, সোনারগাঁ জাদুঘর সরদারবাড়ি,নোয়াইল গ্রামে পোদ্দারবাড়ি,পানাম পুল এবং সংলগ্ন ঈসা খাঁর বাড়ি, ১৯০০ইং সনে শ্রী গঙ্গারাম ও রামচন্দ্র পোদ্দার প্রতিষ্ঠিত এই অঞ্চলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত একমাত্র বহুমূখী হাই স্কুল সোনারগাঁ জি আর ইনিষ্টিটিউশন,মসলিন কাপড় প্রক্রিয়াক্ষেত্র খাসনগর দীঘি, সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহর মাজার ভাগলপু্র পাঁচপীর দরগাহ মাধবপুর,মোগড়াপাড়া শাহসাব বাড়ী,গোয়ালদী মসজিদ,লালপুরী দরবার শরীফ কমপ্লেক্স নুনেরটেক, প্রেসিডেন্ট এরশাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গুচ্ছগ্রাম মায়াদ্বীপ খ্যাত নুনেরটেক, শ্রী লোকনাথ মন্দির ও আশ্রম বারদী, বৈদ্যেরবাজার মাছঘাট,মহজমপুরের টাকশাল এবং হজরত শাহ আলমের দরগাহ,কাঁচপুর সেতু কইকেরহাট সেতু, মেঘনা শিল্প এলাকা।
ঐতিহাসিক এ সোনারগাঁ দেখতে কিভাবে আসবেনঃ
ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত মওলানা হকি স্টেডিয়াম হতে বাসযোগে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে সিএনজি, রিক্সা কিংবা মিশুক দিয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে আসতে পারবেন। এখান থেকে অল্পকিছু দূরেই প্রাচীন পানাম নগরী, পোদ্দার বাড়ি, টাকশাল বাড়ি এবং প্রাচীন বিদ্যাপিঠ সোনারগাঁ জি আর ইনিস্টিটিউশন অবস্থিত। এরপর হাটা পথে কিংবা রিক্সা যোগে গোয়ালদী শাহী মসজিদ। অন্যদিকে মোগরাপাড়া চৌরাস্তা নেমে ফুটওভার ব্রীজ পার হয়ে পায়ে হেটে কিংবা রিক্সা যোগে মোগরাপাড়া বাজারে গেলেই পাবেন হযরত শাহ্, মুন্না শাহ্ ও শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার মাজার এবং ৭০০ পুরনো উপমহাদেশের প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ। এরপর ভাগলপুরে অবস্থিত সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ ও পাঁচপীরের মাজার অবস্থিত।
আপনার মতামত জানান