জামায়াত চায় সংস্কার, বিএনপির দাবি নির্বাচনী রোডম্যাপ

প্রকাশিত

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত গুরুত্ব দিয়েছে সংস্কারে। একই দিনে অনুষ্ঠিত সংলাপে নানা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে আলোচনা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপে আমরা সরকারের কাছে কোনও মাস দিনকাল নিয়ে কথা বলিনি।”

শনিবার বিকেলে বিএনপির পরপরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসে জামায়াতে ইসলামী।

সংলাপ শেষে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “আমাদের দেওয়া দু’টি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে।”

গত ১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন।

মূলত এই সংস্কার কমিশনগুলোকে দলগুলো কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সেটি নিয়ে মতামত চাওয়া হয় এই সংলাপে।

একই সাথে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দলগুলোর কাছ থেকে মতামতও নেওয়া হয়।

প্রথম দিনের সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ছাড়াও এদিন তিনটি আলাদা রাজনৈতিক জোটের সাথে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস।

এই বৈঠকের মতামত নিয়েই সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করবে বলে আগেই জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে এই বৈঠকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং সে জন্য একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা-সহ আরও বেশ কিছু দাবি তুলে ধরে বিএনপি।

এক ঘণ্টাব্যাপী এই সংলাপে বিএনপির মহাসচিব ছাড়াও দলটির স্থায়ী কমিটির আরও পাঁচজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এজন্য আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি।”

এই আলোচনায় নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে কোনও বিতর্কিত ব্যক্তিকে না রাখা, জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল, দেশের সব ইউনিয়নের নির্বাচিত পরিষদ বিলুপ্ত করার দাবিও জানায় দলটি।

বিএনপি মহাসচিব জানান, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া দশম সংসদ থেকে শুরু করে সব জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করা সিইসি ও কমিশনারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

একই সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে রায় দেওয়ায় সাবেক বিচারপতি খায়রুল হককেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি জানানো হয়েছে।

দেশের সাম্প্রতিক কিছু অসঙ্গতি নিয়েও এই সংলাপে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যারা দোসর হয়ে কাজ করেছে, লুটপাট, অত্যাচার ও গুম খুনের সাথে জড়িত ছিল তাদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। তাদেরকে অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছি আমরা।”

শেখ হাসিনা ভারতে থেকে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছেন দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি।

তিনি বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে সে বিষয়টি আরো গভীরভাবে দেখে কারা এ ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা বলেছি।”

সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী ও আমলারা কীভাবে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে সেটি নিয়েও সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে বিএনপি।

এই আলোচনায় বিএনপি বিগত সময় গুম খুনের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেফতারকৃতদের জামিন দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।


৯ই অক্টোবর রূপরেখা জানাবে জামায়াত
বিএনপির পরই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তাদের নেতৃত্ব দেন দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান।

পরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দুটি রোডম্যাপের পাশাপাশি কিছু মৌলিক বিষয় সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন তারা। আগামী ৯ই অক্টোবর জাতির সামনে কী কী সংস্কার প্রয়োজন, তা তুলে ধরবে দলটি।

জামায়াতের আমীর বলেন, “আমরা আমাদের চিন্তা জাতির সামনে তুলে ধরব কী কী সংস্কার এই মুহূর্তে প্রয়োজন, কী কী সংস্কার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের লাগবে।’’

জামায়াতের আমীর সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে? এটা নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করব।”

দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে জামায়াত নেতা বলেন, “দেশের বর্তমান অবস্থায় জনগণ আর সরকার একসাথে কীভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি করতে পারে এবং সকল ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে দেশকে একটা ভাল জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে এটাও আমরা আশা করছি যে এই সময়টা নাতিদীর্ঘ হবে।”

এই বৈঠকে দুর্গাপূজায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার জন্য করণীয় কী হবে, এ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।


অন্য দলগুলো যে সব প্রস্তাব দিয়েছে
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত এই সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেওয়া সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না। সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে।”

এই সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত যে সব জাতীয় অনুষ্ঠিত হয়েছে তার বেশির ভাগই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম সংলাপ শেষে গণমাধ্যমকে বলেন, “স্বৈরাচার, খুনি, ফ্যাসিস্টরা যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়, সেটা নিয়ে আমরা উপদেষ্টাদের বলেছি।”

দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সংস্কারের পাশাপাশি ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব চালুর দাবি জানায় ইসলামী আন্দোলন।

বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “সংস্কার কমিশনের মধ্যে প্রধান হল নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। সেটা আজ থেকে, রাজনৈতিক দল-সহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোড ম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।”

একই সাথে প্রশ্নবিদ্ধ কোনও কাজ না করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পরামর্শ দেয় বাম গণতান্ত্রিক জোট।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত সংলাপে গণঅধিকার পরিষদ অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রকাশ, আওয়ামী লীগের বিচার, অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়ানোসহ ১২ দফা প্রস্তাব তুলে ধরে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রধানের নাম ঘোষণা করেন।

পরে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য সরকার ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচটি কমিশনও গঠন করেছে।

শিগগিরই সংবিধান সংস্কার কমিশনও চূড়ান্ত করা হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে সরকার ও সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা ও মতামত চাওয়া হয় প্রথম দিনের বৈঠকে।

একই সাথে ৯ই সেপ্টেম্বর থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা, আইনশৃঙ্খলা-সহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দলগুলোর সাথেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের সাথে আলাদা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়া জোটগতভাবে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নেতারা সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টার সাথে।

গণতন্ত্র মঞ্চের জোটগত দল জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাথেও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে সন্ধ্যায়।

বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দল সিপিবি, বাসদ খালেকুজ্জামান, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টিও বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টার সাথে।

সবশেষে গণ অধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সঙ্গেও সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় এদিন।

তবে এই বৈঠকে ডাক পায়নি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক ১৪ দলভুক্ত কোনও রাজনৈতিক দল।

সরকার গঠনের পরপর প্রধান উপদেষ্টার সাথে প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতীয় পার্টি আমন্ত্রণ পেলেও এবার তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

শনিবার রাতে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “সংলাপের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এবার আমাদের কিছু জানানো হয় নি। এখনও পর্যন্ত আমরা জানিও না আমাদের ডাকা হবে কি না!”

এর আগের দফা সংলাপে জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানোয় তখন তা নিয়ে নানা বিতর্কও তৈরি হয়েছিল।

আপনার মতামত জানান