রাজিবপুর উপজেলায় দারিদ্রতার অন্যতম কারণ নদীভাঙন!

প্রকাশিত

রাজিবপুর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির যৌথ আয়োজনে ‘পোভার্টি অ্যান্ড আন্ডার নিউট্রিশন ম্যাপস বেজড অন স্মল এরিয়া এস্টিমেশন টেকনিক’ বিষয়ে এক সেমিনারে দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম উপজেলা হিসেবে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার নাম উঠে আসে। এই উপজেলায় দরিদ্রতার হার ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ, যেখানে বাংলাদেশে দরিদ্রতার গড় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। শিক্ষার হার ২৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ, যা জাতীয় গড় সূচকের সর্বনিম্নে অবস্থান করছে।

গত ২২ মে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। মেট্রোপলিটন থানাসহ বাংলাদেশের মোট ৫৭৭টি উপজেলার মধ্যে চর রাজিবপুর সূচকের সর্বনিম্নে রয়েছে। রংপুর অঞ্চল তথা কুড়িগ্রামকে ‘মঙ্গার প্রভাবমুক্ত’ ঘোষণা করা হলেও মঙ্গার কঠিন তিলক লেগে আছে চর রাজিবপুর উপজেলার কপালে। দরিদ্রতার সূচকে রাজিবপুরের এমন চিত্র বিবিসিসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

মাত্র ১১১.০৩ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট্ট উপজেলা তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। দক্ষিণে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলা, পশ্চিমে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র নদ ও চিলমারী উপজেলা, উত্তরে রৌমারী উপজেলা এবং পূর্ব দিকে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য।
এই জীবনে পাঁচবার বাড়ি ভাঙছে, সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। অন্যের জমি লিজ নিয়া কোনোমতে পরিবার নিয়া আছি। আবাদি জমি সব নদীরগর্ভে। একসময় গোলাভর্তি ধান ছিল, পুকুরে মাছ ছিল।
এ প্রতিবেদকের কথা হয় কুড়িগ্রামের রাজিবপুরের কোদালকাটি গ্রামের মৃত ফকির চানের ছেলে মো. নছের আলী (৪০), মৃত শহিদ আলীর স্ত্রী মোছা. আমেলা খাতুন (৫০) ও সফর আলীর ছেলে মো. শহিদুল ইসলামের (৩৮) সাথে। এদের তিনজনেরই পাচঁবার করে নদীতে বিলীন হয়েছে বাড়ি। এখন অন্যের জমি বন্ধক নিয়ে বাড়ি করে আছেন। তারা বলেন, কোনো অভাব ছিল না। নদীভাঙনে আজ সর্বস্বান্ত, এক বেলা খাবার জুটলেও দুই বেলা না খেয়ে থাকতে হয়।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বুক চিড়ে বয়ে গেছে প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র, সোনাভরি, জালচিড়া ও জিঞ্জিরাম নদী। কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়ন ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরি নদীর ভাঙনে সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। নদীর বুকে জেগে ওঠা প্রায় ২৫টি দ্বীপচরে মানুষ অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে। বন্যা আর নদীভাঙনের সঙ্গে সংগ্রাম করে এসব দ্বীপচরের মানুষ জীবন কাটায়। কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের প্রতিটি পরিবার গত ২০ বছরে গড়ে পাঁচবার তাদের বসতবাড়ি নদীতে হারিয়েছে। কোদালকাটি ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ড শংকর মাধবপুর, বিলপাড়া ও সাজাই কারীগরপাড়া নদীতে ভেঙে বিলীন হয়েছে। এই এলাকার মানুষ বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

উত্তর কোদালকাটি নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, নদীভাঙন রোধে কোদালকাটি ইউনিয়নে গত বছর সামান্য কিছু জিও ব্যাগ ফেলতে দেখেছি। তা ছাড়া সরকারিভাবে আর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হাসান সাদিক মাহমুদ বলেন, নদীভাঙনের ফলে ভিটামাটিহারা হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অন্য জায়গায় নতুন করে আবার জমি বন্ধক নিতে হয়। নতুন করে ঘরবাড়ি বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে নিজের যতটুকু সঞ্চয় থাকে তার পুরোটা ব্যয় করেও তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। আবার ওই এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থা বিলীন হয়ে যায়। এভাবে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যাচ্ছে এই উপজেলার মানুষ।


উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। এই বন্যার ফলে ফসলের ক্ষতি হয়। তবে নদীভাঙন এই এলাকার মানুষের দুরবস্থার অন্যতম কারণ। নদীভাঙনের ফলে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। তাদের উন্নতির জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। প্রতিবছর মানুষ নদীতে ভিটামাটি ও কৃষিজমি হারিয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। ফলে দিনমজুরের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বর্ষা মৌসুমে দ্বীপচরগুলো পানিতে ডুবে যায়। স্রোতের টানে বাড়িঘর ও গবাদি পশু ভেসে যাওয়ার দৃশ্য নিত্যকার। ধান, পাট, চীনাবাদাম, ভুট্টা, গম, চিনা, কাউন, মসুর ডাল উপজেলার প্রধান শস্য। আগাম বন্যা ও ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।

এলাকাবাসী জানায়, দ্বীপচরগুলোতে বছরে একটিমাত্র ফসলের চাষ হয়ে থাকে। কৃষিভিত্তিক শিল্পি-কারখানা, ডেইরি ফার্ম, হাঁস-মুরগির খামার, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠলে দ্বীপচরবাসীর ভাগ্যের উন্নয়ন সম্ভব হবে বলে এ জন্য সরকারিভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নদীভাঙন সবচেয়ে বড় সমস্যা। উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীশাসন করে স্থায়ীভাবে ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি। তবে বর্তমান সরকার নদীভাঙন প্রতিরোধে জিআই ব্যাগ ও ব্লক তৈরি করে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিনগণ্য।

তারা জানান, উপজেলাটি ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে জেলা সদর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রশাসনিক কাজসহ সব কাজে-কর্মে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণ করা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের জনগণ সহজেই সম্পৃক্ত হতে পারবে বলে সবার ধারণা।

বর্ষায় নাও আর শুকনা মৌসুমে পাও- এই হচ্ছে দ্বীপচরের সঙ্গে উপজেলা সদরের যোগাযোগব্যবস্থা। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকে। তখন নৌকাই একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। শুকনা মৌসুমে পানি নেমে গেলে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মালামাল পরিবহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হয়। প্রতিবছর বন্যায় কাঁচা-পাকা সব ধরনের রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ কারণে স্থায়ীভাবে কোনো রাস্তা নির্মাণ সম্ভব হয় না। নদী আছে, সেতু নেই। খেয়া নৌকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। এতে সময় অপচয় হয় অনেক।

জানা যায়, উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে বালিয়ামারী কালাইয়ের চর সীমান্তে বর্ডারহাট স্থাপন করা হলেও তা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। জিঞ্জিরাম নদীর ওপর সেতু না থাকায় বর্ডার হাটের আমদানি-রপ্তানি কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ দ্বীপচরে বসবাস করার কারণে উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। জরুরি রোগী ও প্রসূতি মায়ের ক্ষেত্রে আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হতে হচ্ছে। অভাবের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক পাস করেই কর্মের খোঁজে শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমান রাজধানীতে। ফলে ঝরে পড়ে তাদের পরবর্তী শিক্ষাজীবন। এতে শিক্ষার হার দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে।

আপনার মতামত জানান