রক্ষা হয়নি মাদক সম্রাট ইশতিয়াকের

প্রকাশিত

১২ বছর আগেও রাস্তার পরিত্যক্ত বোতল বিক্রি করে জীবন চলত। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। পথ চলতে চলতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পাওয়ার মতো অবস্থা হয় তার। অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। কাগজে-কলমে পরিবহন ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় দানবীর হিসেবে খ্যাতিও কুড়িয়ে নেন তিনি।

প্রথম প্রথম মনে হতে পারে জীবনযুদ্ধে সংগ্রাম করে উঠে আসা কোনো এক শিল্পপতির গল্প। বাস্তবতা হলো, গল্পটি মূলত ‘মাদক সম্রাট’ মো. ইশতিয়াক আহমেদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত ইয়াবা-কারবারি তিনি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে (বিহারি) বেড়ে ওঠা ইশতিয়াকের রাজত্ব ছিল মোহাম্মদপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, বেড়িবাঁধ, হেমায়েতপুর ও আশুলিয়াসহ কয়েকটি এলাকায়। মূলত ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন তিনি। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। অবৈধ পথে অর্জিত কোটি কোটি টাকাও কাজে আসেনি ইশতিয়াক আহমেদের। বরং পুলিশ কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখে ফেরারি আসামি তিনি।

ইতোমধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুই মামলায় আসামি হয়েছেন ইশতিয়াক আহমেদ ও তার স্ত্রী পাখি। শুধু আসামি নন, অবৈধভাবে অর্জিত ইশতিয়াকের নিজের নামে রাখা ২৭ লাখ ৪০০ টাকা, আশুলিয়ার বাইপাইল মৌজায় ৪.৭০ শতাংশ ভূমির ওপর এক তলা বাড়ি; ইশতিয়াক ও তার স্ত্রীর নামে আশুলিয়ার বাইপাইল মৌজায় ৪ শতাংশ জমির ওপর ছয় তলা ভবন এবং দিয়াখালী মৌজার ৮.২৮৩ শতাংশ জমির ওপর সাত তলা ভবন আদালতের নির্দেশনায় ক্রোক করা হয়েছে।

এছাড়া ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য-উপাত্তসহ সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও হত্যাসহ ১২ থেকে ১৫টি মামলা তো আছেই।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইশতিয়াক ভারতে পালিয়ে গেছেন। পরিবার কিংবা পুলিশের কাছে তার অবস্থান সম্পর্কে যথাযথ তথ্য পাওয়া না গেলেও চলতি বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইশতিয়াকের স্ত্রী পাখি দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে ইশতিয়াক ভারতে মারা গেছেন বলে দাবি করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে ইশতিয়াকের শ্যালক (পাখির ভাই) রাজুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান পাখির জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি স্বীকার করলেও বিস্তারিত বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।

অন্যদিকে, তদারককারী কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইশতিয়াক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। আদালতের নির্দেশনায় কিছু সম্পদও জব্দ করা হয়েছে।

ইশতিয়াক দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলায় যা আছে

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদবিবরণী দাখিল না করার অভিযোগে জেনেভা ক্যাম্পের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী মো. ইশতিয়াক ও তার স্ত্রী পাখির বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা দায়ের হয় ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন।

এজাহারে বলা হয়, ইশতিয়াক ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ৩৭ লাখ ৪০ হাজার টাকায় আশুলিয়ার বিলামালিয়া মৌজায় ৪.৭০ শতাংশ জমিসহ এক তলাবিশিষ্ট ভবন ক্রয় করেন। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই আশুলিয়ার দিয়াখালী মৌজায় ৮.২৮৩ শতাংশ জমি নিজ ও স্ত্রীর নামে ৪১ লাখ ৫৮ হাজার টাকায় রেজিস্ট্রেশন হয়। পরবর্তীতে সাত তলা ভবন নির্মাণ হয়। ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল ৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার ওপর ছয় তলা ভবন নির্মাণসহ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। যে কারণে ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই ইশতিয়াক ও তার স্ত্রী পাখির বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়।

কিন্তু সম্পদের হিসাব কমিশনে দাখিল না করায় তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ধারায় এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন করে তা দখলে রাখায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন- ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।

আয়কর বিবরণীতে যা আছে

ইশতিয়াক ও তার স্ত্রী পাখীর নামে পাওয়া এনআরবি ব্যাংক আশুলিয়া শাখা থেকে ঋণ গ্রহণের আবেদনপত্র, ব্যাংকে হিসাব খোলার আবেদনপত্র, ক্রেডিট কার্ডপ্রাপ্তির আবেদনপত্র, ইশতিয়াকের অনুকূলে ট্রেড লাইসেন্স, দাখিল করা টিন সার্টিফিকেট, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি খতিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় ইশতিয়াক একজন পরিবহন ব্যবসায়ী। ‘শাহজালাল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি’ নামে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

ইশতিয়াক দাখিল করা আয়কর রিটার্ন ও বিভিন্ন রেকর্ডপত্রে দাবি করেছেন, তার মাসিক আয় দুই লাখ টাকা, তার স্ত্রীর আয় ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া বাড়ি ভাড়া বাবদ আয় দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। মোট মাসিক আয় পাঁচ লাখ টাকা এবং মাসিক ব্যয় ৬০ হাজার টাকা।

তবে দুদকের অনুসন্ধানে তাদের কয়টি গাড়ি ছিল, কীভাবে পরিবহন ব্যবসা পরিচালনা করেন— সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই দুদক মনে করছে, তার ব্যবসা মূলত কাগজে-কলমে ছিল। প্রকৃত অর্থে তিনি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং ওই আয় বৈধ করার জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। অবৈধ সম্পদ বৈধ করতেই তার এত আয়োজন।

মামলার আগে দুদকের অনুসন্ধান পর্যায়ে ইশতিয়াক দম্পতিকে ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। হাজির না হলে পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১২ জুন জেনেভা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ও ইশতিয়াককে তলব করে আবারও চিঠি দেওয়া হয়। এবারও ইশতিয়াক দম্পতি হাজির হননি। এমনকি কোথায় আছেন স্থানীয় মানুষ কিংবা লোকাল থানা হদিস দিতে পারেনি।


দুদকে আসা অভিযোগে যা বলা হয়েছে

মোহাম্মদপুরের মাদক সম্রাট মো. ইশতিয়াক আহমেদ তার ভাই মাহবুব ও নাদিমসহ আরও ১০০ কর্মচারীর মাধ্যমে ইয়াবা, গাঁজা ও অন্যান্য মাদক পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা অর্জন করেছেন। তার অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে ধানমন্ডিতে চার কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, বনানী ও গুলশানে ২০ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট, পূর্বাচলে একাধিক প্লট, যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকা। এছাড়া তার স্ত্রীর নামে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে।

এসব তথ্য খতিয়ে দেখতে দুদক অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে ইশতিয়াক দম্পতির নামে নথিপত্র তলব করে চিঠি দেয়। যার যাচাই-বাছাই এখনও চলমান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইশতিয়াক ছিলেন জেনেভা ক্যাম্পের মাদকের মূল নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শহরের প্রধান ইয়াবা সরবরাহকারী। কক্সবাজার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান নিজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরবরাহ করতেন। তার বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর থানায়।

২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অভিযান চালালে ইশতিয়াক তার সহযোগীদের নিয়ে পালিয়ে যান। তবে তার ছোট ভাই মাহবুব গ্রেফতার হন। ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) সঙ্গে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, এপিবিএন ও এনএসআইয়ের ২০০ সদস্য জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালায়। গ্রেফতার করা হয় ইশতিয়াকের প্রধান সহযোগী নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশকে। যদিও মাত্র ১২ দিনের মাথায় ছাড়া পান তিনি।

দেশজুড়ে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে ইশতিয়াক সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্য গা ঢাকা দেন।

আপনার মতামত জানান