বাবা মায়ের যে সব আচরণ শিশুরা সারাজীবন মনে রাখে

প্রকাশিত

একটা সময় ছিলো যখন মনে করা হতো শিশুরা বয়স্কদের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। বিশেষ করে গ্রীক ও রোমান চিত্রকলার মধ্যযুগের ছবিগুলোতে যেভাবে শিশুদেরকে চিত্রায়িত করা হয়েছে তা থেকে শিশুদের সম্পর্কে এমন দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে উঠে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী আর শিক্ষাবিদরা তাদের প্রচুর গবেষণা আর পরিশ্রমের দ্বারা শিশুর স্বতন্ত্র সত্ত্বার ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

সমসাময়িক দার্শনিক রুশোর মতে “শিশুরা জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের উচিত প্রতিটি শিশুর স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা করে তাদের সাথে যথাযথ আচরণ করা।”

শিশুর স্বতন্ত্র সত্ত্বার এই ধারণাটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রথমে ইউরোপে এবং পরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে শিশুর অভিভাবক কিংবা তার চারপাশের মানুষজনের অনেকেই আজও একথা মানতে নারাজ যে প্রতিটি শিশু আলাদা, তার আগ্রহ এবং সক্ষমতার ধরণ স্বতন্ত্র। আর এর ফলে শিশুর বর্ধন ও বিকাশের বেলায় আমরা অভিভাবকেরা তার সাথে যে আচরণ করি তা সহায়ক না হয়ে বরং অনেকটা চাপিয়ে দেওয়া গোছের হয়ে যায়। যার ফলাফল শিশুকে জীবনব্যাপী বয়ে বেড়াতে হয়। আজকের এই আয়োজনে থাকবে পিতামাতার তেমনই কিছু আচরণের কথা যা শিশুর শিক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে আর শিশু তা মনে রাখে আজীবন।

সন্তানের সাথে যে সময়টুকু আপনি কাটান

সন্তানের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশের জন্য চাই অভিভাবকের সাহচর্য। সন্তানের শুধু মানসিক বিকাশই নয়, শারীরিক বিকাশ ও বর্ধনেও রয়েছে পিতামাতার সাহচর্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেসব বাবামায়েরা তাদের সন্তানকে সময় দেন সেসব শিশুর মাঝে সৃজনশীলতা এবং সামাজিক সক্রিয়তা তুলনামূলক বেশি থাকে এবং তারা বন্ধুভাবাপন্ন হয়। অনেকেই মনে করেন যে মায়ের সাহচর্যই সন্তানের জন্য যথেষ্ট। ধারণাটি একেবারেই সঠিক নয়। ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসলের এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব বাবারা তাদের সন্তানকে বেশি সময় দেন তাদের আইকিউ (IQ), যেসব বাবারা সময় কম দেন তাদের সন্তানদের থেকে বেশি। শিশুর সাথে ভালো সময় কাটানো আসলে এক ধরণের বিনিয়োগের মতন। আপনার সন্তানের সাথে আপনি যত বেশি ভালো সময় কাটাবেন তার সাথে আপনার সম্পর্কও ততোই ভালো হবে যা শিশুটির ভবিষ্যতকে করবে সুরক্ষিত।

একটু যদি নিজের অতীতে ফিরে যান তাহলে দেখবেন আপনার বাবা মা আপনার সাথে যে ভালো সময়টুকু কাটিয়েছেন তার সুখস্মৃতি আপনার মনে আজও জাগ্রুক। তাহলে সেটি আপনার সন্তানের বেলায় নয় কেন?

সন্তানের সাথে কথা বলার ধরণ

নিঃসন্দেহে শিশুর সাথে সবচেয়ে বেশি আন্তঃযোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া হয় তার বাবামায়ের। তাই বাবামায়ের কথা বলার ধরণ তার মনে ব্যাপক ছাপ ফেলে।শিশুকে স্নেহ ও উৎসাহপূর্ণ কথা বলা হলে তার মাঝে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং তার মানসিক বিকাশ ভালো হয়। অন্যদিকে যেসব বাবামায়েরা সন্তানের সাথে উঁচু গলায়, তিরস্কারের ভঙ্গিতে কিংবা তাচ্ছিল্যের স্বরে কথা বলেন সেসব শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিশু নিজেকে অযাচিত ভাবে যা তার সামাজিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। মনে রাখবেন, আপনার গলার স্বর আর কথাবলার ধরণই আপনার কাছে শিশুটির গ্রহণযোগ্যতা এবং তার প্রতি আপনার মনোভাবকে তুলে ধরে।

সন্তানের সামনে আপনি আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর সাথে কেমন আচরণ করেন ?

বাবামায়ের সম্পর্ক সন্তানের বর্ধন ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। স্বামী স্ত্রী যদি ঝগড়া করেন বা তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো না হয় তাহলে শিশুটি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অনেকসময় পিতামাতা নিজেদের মাঝে খারাপ সম্পর্ক বা ঝগড়ার কারণে সন্তানের সাথে খারাপ ব্যাবহার এমনকি মারধরও করে থাকেন। এতে করে পিতামাতার প্রতি সন্তানের ঘৃণা জন্ম নেয়, অনেক সময় সে এ ধরনের অশান্তির জন্য নিজেকে দায়ী করে থাকে। তাছাড়া শিশুর সামনে সঙ্গী/ সঙ্গিনীকে তিরস্কার কিংবা কটুক্তি করলে শিশুটি সে এধরণের আচরণ রপ্তও করে ফেলে যা তার আচরণগত বিকাশ ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে বাঁধা দেয়। এছাড়াও পিতামাতার খারাপ সম্পর্ক শিশুর মনে দাম্পত্য জীবনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি করতে পারে বলেও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন।

অন্যদিকে পিতামাতার ভালো সম্পর্ক শিশুটির জন্য সবসময়ই উৎসাহব্যঞ্জক। বাবামায়ের ভালো সম্পর্ক একদিকে যেমন তাকে আনন্দ দেয়, আচরণ গঠনে সহায়তা করে তেমনি সে নিরাপত্তা অনুভব করে।

অপ্রত্যাশিত উপহার !!

উপহার পেতে সবাই ভালবাসে। আর শিশুদের বেলায় তো কথাই নেই। আর সেই উপহারটি যদি হয় সারপ্রাইজ তাহলে শিশুটি খুবই খুশি হয়। কারণ শিশুরা সারপ্রাইজ ভালোবাসে।আমরা আমাদের সারপ্রাইজগুলো কখনোই ভুলতে পারিনা। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনার শিশুকে সবসময় দামি উপহার দিয়ে চমকে দিতে হবে। সাধারণভাবে আপনি যা করেন কখনো কখনো সেই গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসুন। একই জিনিস একটু ভিন্নভাবে করুন যা আপনার শিশুর মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।ধরুন, আপনার শিশুটির জন্মদিন সবসময় একভাবে পালন করেন। একটা জন্মদিন হয়তো একটু ভিন্নভাবে পালন করলেন। যেমন, গ্রামের বাড়িতে জন্মদিনটি পালন করা কিংবা তার পছন্দের কোন জায়গায় তাকে নিয়ে যাওয়া। আবার হয়তো পরিবারের সবাই মিলে হুট করে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারেন যা সময় সুযোগের অভাবে অনেকদিন ধরেই হয়ে উঠছে না।নিদেনপক্ষে তাকে আপনি কতটা ভালবাসেন, তার কোন কোন দিকগুলো আপনার খুব ভালোলাগে তা জানিয়ে একটা চিঠিও কিন্তু লিখতে পারেন। এমনকি প্রতিদিন যদি তার সাথে আপনার দেখা হয় তবুও।

যখন আপনার সন্তানকে নতুন কিছু শেখার সুযোগ করে দেন

ইংরেজিতে ‘লার্নিং মোমেন্ট’ বলে একটা কথা আছে।এর মানে হলো সেই মুহূর্তটি যখন আমরা নিজে নিজে কোন কিছু শিখতে পারি। আপনার সন্তানটিকে ‘লার্নিং মোমেন্ট’ দেওয়ার চেষ্টা করুন।তাকে শেখার সুযোগ করে দিন।প্রতিটি শিশুর মাঝেই রয়েছে একটি অনুসন্ধিৎসু মন, তারা সবসময়ই নতুন কিছু শিখতে চায়।অন্যদিকে অভিভাবকেরা সাধারণত শিশুকে কোন কাজ করতে দিতে চাননা, তারা ভয় পান।অথচ বাবামায়ের একটুখানি সচেতনতা আর সহযোগিতা শিশুকে নতুন কিছু শেখার দারুণ সুযোগ করে দিতে পারে। ধরুন, শিশুটি সাইকেল চালানো শিখতে চায়। এখন আপনি যদি পড়ে যাওয়া কিংবা আঘাত পাওয়ার ভয়ে তাকে সাইকেল চালানো শেখা থেকে তাকে বিরত রাখেন তাতে লাভ কিন্তু খুব বেশি কিছু নেই।বরং তার পাশে থেকে তাকে শিখতে সাহায্য করুন এতে যেমন শিশুটি নতুন কিছু শিখবে যা তার মাঝে তৈরি করবে স্বনির্ভরতা আর আত্মবিশ্বাস তেমনি আপনাদের সম্পর্কটিও হবে আরও রঙ্গিন। এভাবে শুধু সাইকেল চালানোই নয় বরং আপনার সন্তানের পাশে থেকে জীবনদক্ষতা বাড়ায় তেমন অনেক কিছুই তাকে আপনি শেখাতে পারেন।

সন্তানকে আপনি কতখানি গুরুত্ব দেন ?

আমরা অভিভাবকেরা প্রায়শই শিশুদের কথাগুলো একদমই শুনতে চাইনা। তাদের চাওয়া, আগ্রহ কিংবা মতামত বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কাছে অগ্রাহ্য হয়। আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলো তাদের উপর চাপিয়ে দেই, কারণ আমরা মনে করি আমরা শিশুটির জন্য যে সিদ্ধান্তটি নেবো সেটিই তার জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু এতে করে শিশুটি তার আগ্রহ আর সম্ভাবনাগুলোকে হারিয়ে ফেলে। তাই শিশুদের মতামত এবং তাদের কথাগুলো শোনাও জরুরি। প্রয়োজনে তার সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আপনি যখন শিশুটিকে গুরুত্ব দেবেন, তার মতামতকে সম্মান করবেন তখন তা শিশুর জন্য বলবর্ধক বা রিএনফোর্সমেন্ট হিসেবে কাজ করে। এ ধরণের বলবর্ধক একদিকে যেমন শিশুর মাঝে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি ও ব্যক্তিত্বের গঠনে সাহায্য করে তেমনি বাবামায়ের সাথে আসক্তিও বেড়ে যায় বহুগুণ।

আপনার মতামত জানান