ঘুরে দেখুন সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক স্থান

প্রকাশিত



ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ মানুষই গ্রামে ছুটেন। তবে যারা রাজধানীতে ঈদের ছুটি কাটাবেন ও আশপাশে কোথাও ঘুরতে যেতে চান, তারা চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ের ঐতিহ্য।

পানাম নগর, প্রবেশমূল্য ১৫ টাকা

ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক নগরের তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় স্থান করে নেয় বাংলার এক নগর। যাকে আমরা সবাই চিনি পানাম নগর নামে। ঢাকার খুব কাছেই, মাত্র ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগঞ্জের খুব কাছে সোনারগাঁতে অবস্থিত এই নগর।



ঐতিহাসিক স্থানে ভ্রমণ করতে ভালবাসেন তাদের জন্য পানাম নগর হতে পারে সেরা এক স্থান। ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ায় ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় স্থানটি। শুধু ভৌগোলিক অবস্থা নয়, এর জনপ্রিয়তার পেছনে আছে শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

এককালের জৌলুষ আজ না থাকলেও, হারানো নগরী হিসেবে পরিচিত এই পানাম নগরে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন স্থাপনা। পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি। পানাম বাংলার প্রাচীনতম শহর। এক সময় ধনী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস ছিল এখানে।

ছিল মসলিনের জমজমাট ব্যবসা। প্রাচীন সেই নগরীর তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এখন আছে শুধু ঘুরে দেখার মতো ঐতিহাসিক পুরনো বাড়িগুলো। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সোনাগাঁওয়ে।

পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থান কাপড়, দেশ থেকে যেত মসলিন। শীতলক্ষ্যা আর মেঘনার ঘাটে প্রতিদিনই ভিড়তো পালতোলা নৌকা।

ওই সময়ই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠে পানাম নগরী। পরবর্তিতে এই পোশাক বাণিজ্যের স্থান দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ইংরেজরা এখানে বসিয়েছিলেন নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র।

ঈসা খাঁ’র আমলের বাংলার রাজধানী পানাম নগর। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর -প্রাচীন সোনারগাঁর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরোনো অনেক ভবন আছে, যা বাংলার বার ভূইয়াঁদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

সোনারগাঁ এর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই নগরী গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। জানা যায়, ১৪০০ শতাব্দীতে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে পৃথিবীর নামি-দামি শিক্ষকরা পড়াতে আসতেন। এখানে একটি ভৃত্য বাজার ছিল বলে জানা যায়।

পানাম নগরী এর দুই ধারে ঔপনিবেশিক আমলের মোট ৫২টি স্থাপনা আছে। এর উত্তরদিকে ৩১টি ও দক্ষিণদিকে ২১টি স্থাপনা অবস্থিত। স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মোঘল শিল্পরীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। পানাম নগরী নিখুঁত নকশার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কূপসহ আবাস উপযোগী নিদর্শন রয়েছে। নগরীর পানি সরবরাহের জন্য দু’পাশে খাল ও পুকুর আছে। এখানে আবাসিক ভবন ছাড়াও উপাসনালয়, গোসলখানা, পান্থশালা, দরবার কক্ষ ইত্যাদি আছে।



পানাম নগরের আশপাশে আরও কিছু স্থাপনা আছে যেমন- ছোট সর্দার বাড়ি, ঈশা খাঁর তোরণ, নীলকুঠি, বণিক বসতি, ঠাকুর বাড়ি, পানাম নগর সেতু ইত্যাদি।

 



লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা

পানাম নগর ঘুরে চলে যেতে পারেন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে পথে। আবহমান গ্রাম বাংলার লোক সাংস্কৃতিক ধারাকে বিকশিত করার উদ্যোগে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয়ের ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।

পরে ১৯৮১ সালে ১৫০ বিঘা আয়তনের কমপ্লেক্সে খোলা আকাশের নিচে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশে গ্রামীণ রূপকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকান্ডের পরিচয় তুলে ধরতে শিল্পী জয়নুল আবেদিন এই জাদুঘর উন্মুক্ত পরিবেশে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কমপ্লেক্সটি প্রায় ১০০ বছর পুরাতন সর্দার বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। মোট ১০টি গ্যালারি আছে এতে। গ্যালারিগুলোতে কাঠ খোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, তামা-কাসা-পিতলের নিদর্শন, লোহার তৈরি নিদর্শন, লোকজ অলংকারসহ আছে বহু কিছু।

ভবনটির সামান্য পূর্বে দেখবেন লোকজ স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ আধুনিক এক ইমারতে প্রতিষ্ঠিত জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর। এই ভবননে আছে মাত্র দুটি গ্যালারি। একটি গ্যালারি কাঠের তৈরি, যা প্রাচীন ও আধুনিক কালের নিদর্শনসমৃদ্ধ।

তাছাড়া বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, বৈশিষ্ট্য কাঠ ও কাঠ থেকে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি এমনকি সর্বশেষ বিক্রির সামগ্রিক প্রক্রিয়া, অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে সুন্দর মডেল দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে, দুটি ভবনের বাইরে আছে পাঠাগার, ডকুমেন্টেশন সেন্টার, সেমিনার হল, ক্যান্টিন, কারুমঞ্চ, গ্রামীণ উদ্যান ও বিভিন্ন রকমের বৃক্ষ, মনোরম লেক, লেকের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌ বিহার, মৎস্য শিকারের সুন্দর ব্যবস্থা ও নৌকা। চাইলেই মাত্র ১৫০ টাকার বিনিময়ে ৩০ মিনিটে জন্য চালাতে পারবেন এখানে নৌকা।

পানাম নগরী থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দুরত্বে আছে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। ৫০ টাকা টিকেট কেটে ঢুকেই হাতের বামে পাবেন, বিশাল দীঘি। আর সেই চিরচেনা ভবন বড় সর্দার বাড়ি।

বড় সর্দার বাড়ি, প্রবেশ মূল্য ১০০ টাকা

সোনারগাঁওয়ের এই বড় সর্দার বাড়ির ইটের ফাঁকে ফাঁকে ইতিহাস, বাতাসের অনুরনণে দুর্বোধ্যতা আর মেঝে জুড়ে রহস্য ও রোমাঞ্চ। খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর আর গুপ্তপথ নিয়ে বড় সর্দার বাড়ি। অবয়বে পুরনো বৈভব নেই কিন্তু বৈভবের চলে যাবার দাগ রয়েছে।

বাড়ির সামনে দেখবেন দীঘি। ঝলমল রাতে প্রাসাদের লাল, নীল, সবুজ চিনামাটির ভাঙা প্লেটের উপর চাদের আলো পরে আর তার ছায়া চিকমিক করে দীঘির পানিতে পড়ে অপরূপ ছায়াবাজির সৃষ্টি করে।

বাংলার তাজমহল


ভারতের আগ্রার তাজমহলের কথা তো সবাই জানেন। সেটার অনুকরণেই নারায়ণগঞ্জে শিল্পপতি চলচ্চিত্রকার আহসান উল্লাহ মনি নির্মাণ করেছেন বাংলার এই তাজমহল। ঢাকা থেকে ১০ মাইল পূর্বে সোনারগাঁয়ের জামপুর ইউনিয়নের পেরাব গ্রামে অবস্থিত এটি। এটি তৈরি করতে প্রায় ৫ বছর সময় লাগে এবং এটি ব্যক্তি-মালিকানাধীন। এটি প্রায় ১৮ বিঘা জমির উপর অবস্থিত। আশেপাশে আরও ৫২ বিঘা জমি আছে পর্যটনের জন্য। এখানে দেখা যাবে চারপাশের সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ, হাজার হাজার নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির করা বিকেল আপনার মন ভালো করে দিবে।

তাজমহলের নির্মাণ কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বিদেশী উপকরণ যেমন ১৭২টি কৃত্রিম ডায়মন্ড, ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। নির্মাণ কাজে ৬ জন টেকনিশিয়ানদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ভারতের তাজমহলকে অনুসরণ করা হয়েছে বলে নির্মাতাকে ভারতে যেতে হয়েছে অনেকবার।


২০০৮ সালে এর উদ্বোধন হয়। পর্যটকদের জন্য এখানে প্রবেশের আগে চমৎকার ১০ টি ঝর্ণা রয়েছে যা মুগ্ধ হয়ে দেখার মতোই।

তাজমহলের আশেপাশে ফুলের বাগান আর নিরিবিলিতে বসার স্থান রয়েছে অনেক। তাজমহলটির ভেতরের মূল মহল দারুণ সব পাথর দিয়ে মোড়ানো আর টাইলস করা। মহলের ভেতরে আহসানউল্লাহ্ মনি ও তার স্ত্রী রাজিয়া দু’জনের কবরের স্থান সংরক্ষিত আছে। “বাংলার তাজমহল” এ আগ্রার তাজমহলের মতোই চার কোণে চারটি বড় মিনার রয়েছে।

তাজমহলের ভেতরে আরও রয়েছে “রাজমনি ফিল্ম সিটি স্টুডিও”। তাজমহলের বাইরে রয়েছে “রাজমনি ফিল্ম সিটি রেস্তোরাঁ”, আরও বিভিন্ন খাবারের দোকান, হোটেল, আবাসিক ভবন, জামদানি শাড়ির দোকান, হস্তশিল্প সামগ্রী, মাটির গহনা সহ আরও অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর দোকান। এর আশেপাশে রয়েছে বিভিন্ন পিকনিক স্পট, চাইলে সেসব জায়গাও ঘুরে আসতে পারেন।

কীভাবে যাবেন বাংলার তাজমহল?
বাংলার তাজমহল ঢাকা থেকে ২৫ কি. মি. দূরত্বে অবস্থিত । ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে ভৈরব, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জগামী যে কোনো গাড়িতে চড়ে বরপা বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়, সেক্ষেত্রে ভাড়া হবে ২৫ টাকা । এখান থেকে সিএনজি স্কুটারে জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যেতে পারেন তাজমহলে ।

অন্যভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে কুমিল্লা, দাউদকান্দি অথবা সোনারগাঁগামী যেকোনো গাড়িতে চড়ে মদনপুর বাসস্ট্যান্ডে নামতে হয়। সেক্ষেত্রে ভাড়া লাগে ২০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি বা স্কুটারে জনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় তাজমহলে ।

বাংলার তাজমহলটি মাত্র ১৫০ টাকার টিকিট বা প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে দেখেন দর্শনার্থীরা। গাড়ি পার্কিং ২০ টাকা ।

সময়সূচী: প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা।

সোনারগাঁয়ের মেঘনার চরে ভেসে থাকা মায়াদ্বীপ



ঢাকার কাছে সোনারগাঁয়ের বারদী ইউনিয়নের নুনেরটেকের মায়াদ্বীপ অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে খুব অল্প সময়ে। নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য আদর্শ এক স্থান এটি। ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটাতে যেতে পারেন এই চরে।

সারাদিনের জন্য ঘুরতে পারবেন সেখানে। নদীর তীরে ট্রলারে পড়ন্ত বিকেল কাটানোর স্মৃতি মনে গেঁথে থাকবে সব সময়।

কীভাবে যাবেন? গুলিস্তান থেকে দোয়েল বাসে স্বদেশ পরিবহন এ মোগরাপাড়া যাবেন। ভাড়া নিবে ৭০ টাকা। মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় নামার পর আশেপাশে অনেক দোকানপাট বা হোটেলে খেয়ে নিতে পারেন। সেখানে নেমে বৈদ্যের বাজার অথবা আনন্দ বাজারের এর জন্য সিএনজি নেবেন। ভাড়া নিবে ৫০ টাকা। এরপর আনন্দ বাজার থেকে ট্রলারে মায়াদ্বীপের ভাড়া নেবে ১০ টাকা।

আপনার মতামত জানান