কাবিননামা বিষয়ে জেনে রাখা জরুরী

প্রকাশিত



বিবাহের সময় সরকারকর্তৃক নির্ধারিত কাজির মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে বিবাহের নিবন্ধন করতে হয়। যে ফরমে বিবাহ নিবন্ধন করা হয়, তাকে ‘নিকাহনামা’ বা ‘কাবিননামা’ বলা হয়। উক্ত নিবন্ধন ফরমে মোট ২৫টি ধারা আছে। এতে মৌলিকভাবে যে বিষয়গুলো রয়েছে, তা হলো—স্বামী-স্ত্রীর নাম ও পরিচয়, বয়স, বিবাহ ও নিবন্ধনের স্থান ও তারিখ, স্বাক্ষী ও উকিলদের নাম ও পরিচয়, দেনমোহরের পরিমাণ এবং তা নগদ ও বাকির বিবরণ, স্বামীকর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের অধিকার প্রদান ও শর্তসমূহের বিবরণ, কাজির স্বাক্ষর ও সিলমোহর ইত্যাদি।

তবে কাবিননামার ধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো ১৮ নম্বর ধারা। এতে স্বামীকর্তৃক নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর তা স্ত্রীর জন্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে খুবই কাজে আসে। কেননা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের যখন এতটা অবনতি ঘটে যে তাদের পক্ষে সংসার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে কষ্টের বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য ইসলাম স্বামীকে তালাকের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানোর বিধান দিয়েছে। কিন্তু কোনো স্বামী যদি এহেন অবস্থায় তালাকের পথ অবলম্বন না করে, স্ত্রীকে আটকে রেখে জুলুম-নির্যাতন করতে থাকে, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর অধিকার রক্ষার্থে ইসলাম ‘তালাকে তাফবিজ’-এর নিয়ম প্রবর্তন করেছে। অর্থাৎ স্বামীকর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের পূর্বানুমতি প্রদান করা; যেন প্রয়োজনবোধে স্ত্রী নিজেই তালাক গ্রহণ করতে পারে। স্ত্রী বা স্ত্রীপক্ষের জন্য বিয়ের কাবিননামা পূরণের সময়ই স্বামীর কাছ থেকে সেই অধিকার নেওয়ার সুযোগ ইসলামে আছে। ইসলামী আইনে এটিকে ‘তালাকে তাফবিজ’ বলা হয়।

তবে এই ধারাটি পূরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের ভুল ও শরিয়তপরিপন্থী কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে। ফলে দেখা যায়, ‘তালাকে তাফবিজ’ সঠিকভাবে না হওয়ায় নির্যাতিত স্ত্রী জালিম স্বামী থেকে পরিত্রাণের উপায় পাচ্ছে না। অন্যদিকে বিয়ের পর অনেক স্ত্রী অকারণে বা অযথা কারণ দেখিয়ে তালাক গ্রহণ করে থাকে। অনেক মেয়ে পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে স্বামীর ওপর মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। যেটা স্বামী বেচারার ওপর সীমাহীন জুলুম। আবার সামান্য কারণে রাগের মাথায় হুট করে স্বামীকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। রাগ ঠাণ্ডা হলে পুনরায় ঘর-সংসার করতে চায়। এ অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে পুনরায় মিলিত হওয়ার শরিয়তসম্মত কোনো উপায়ও থাকে না। তখন চিরতরে আফসোসে ভুগতে হয়। তাই আমরা নিম্নে এ সংক্রান্ত ইসলামী আইন নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

কাবিননামার ১৮ নম্বর ধারায় শর্তযুক্ত তালাকে তাফবিজ

তালাক প্রদানের অধিকার একমাত্র স্বামীর, স্ত্রীর নয়। তবে স্বামী উক্ত ক্ষমতা স্ত্রীকে অর্পণ করলে স্ত্রী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করতে পারে। শর্তসাপেক্ষে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করলে বাস্তবে শর্ত পাওয়া যাওয়ার পরই উক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ সঠিক হবে। এ ক্ষেত্রে অকারণে বা অযৌক্তিক কারণে অথবা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তালাকের ক্ষমতা প্রয়োগ করলে পূর্বোক্ত শর্ত না পাওয়া যাওয়ায় তালাক পতিত হবে না। (হেদায়া ২/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৩/৩১৫)

স্বামী শর্তের প্রতিফলন অস্বীকার করার বিধান

যেসব শর্তের প্রতিফলন বিষয়ে স্ত্রী ছাড়া সাধারণত অন্য কেউ অবগত হতে পারে না, ওই শর্তসমূহ পাওয়ার ব্যাপারে শুধু স্ত্রীর দাবিই যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে স্বামীর অস্বীকৃতি আইনত গ্রহণযোগ্য নয়। আর যেসব শর্তের ওপর অন্য লোকও অবগত হতে পারে, সেসব শর্ত পাওয়ার বেলায় স্বামী অস্বীকার করা অবস্থায় শুধু স্ত্রীর দাবি যথেষ্ট নয়; বরং স্ত্রী দুজন পুরুষ বা একজন পুরুষ দুজন নারীর সাক্ষ্য দিলে তার দাবি গৃহীত হবে, অন্যথায় প্রত্যাখ্যাত হবে। (আল বিনায়া ৫/১৮১)

তাফবিজ দ্বারা কত ও কী জাতীয় তালাকের অধিকারী হয়

কাবিননামায় স্বামী স্ত্রীকে যত তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করবে, স্ত্রী তত তালাকেরই অধিকারী হবে। আর যদি কোনো সংখ্যা উল্লেখ না করে সাধারণভাবে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করে, তাহলে স্ত্রী এক তালাকে রজঈর মালিক হবে। এ ক্ষেত্রে স্বামী চাইলে এককভাবেই ফেরত নিয়ে পুনরায় আগের মতো স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সংসার করতে পারবে। আর সুস্পষ্ট বাইন তালাকের কথা উল্লেখ করা হলে তখন তালাক গ্রহণের মাধ্যমে বাইন তালাক পতিত হবে বিধায় সে ক্ষেত্রে স্বামীর এককভাবে ফেরত নেওয়ার অধিকার থাকবে না। তদ্রুপ স্বামী তাফবিজের ক্ষেত্রে তিন তালাকের নিয়ত করলে তিন তালাকের তাফবিজও কার্যকর হবে। (ফাতহুল কাদির ৩/৪১২, রদ্দুল মুহতার ৩/৩১৫)

স্ত্রী স্বামীকে ‘তালাক দিলাম’ বললে তালাক হয় না

তালাক দেওয়ার ক্ষমতা ইসলামকর্তৃক স্বামীর ওপরই অর্পণ করা হয়েছে। তবে স্বামীকর্তৃক তালাকের ক্ষমতা স্ত্রীকে অর্পণ করা হলে ওই ক্ষমতাবলে স্ত্রী নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করতে পারে। স্ত্রী তালাক গ্রহণের কথা এভাবে বলবে বা লিখবে, ‘আমি স্বামীকর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করলাম। ’ স্ত্রী নিজের ওপর তালাক অর্পণ না করে স্বামীকে ‘তালাক দিলাম’ বললে তা পতিত হয় না। (ফাতাওয়ায়ে কাজিখান ২/২৫১)

তাবেঈন মানসুর (রহ.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলেছে, ‘তোমার তালাক গ্রহণের ক্ষমতা তোমার হাতে। ’ এ কথা শুনে স্ত্রী বলল, ‘আপনি তিন তালাক। ’ এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাকে বৃষ্টি না দিন (অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য সফল না হোক)। ’ যদি সে (এভাবে না বলে) বলত, ‘আমি তিন তালাক’, তাহলে যা বলেছে তা-ই হতো। ’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : হাদিস ১৮০৮৮, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : হাদিস ১১৯১৮)

স্বামী তালাকের অধিকার দেওয়ার পর ওই অধিকার প্রত্যাহার

স্ত্রীকে নিঃশর্ত বা শর্ত সাপেক্ষে তালাকের ক্ষমতা দেওয়ার পর তা প্রত্যাহার করার অধিকার স্বামীর থাকে না। তাই স্ত্রী শর্ত পাওয়ার পর নিজ নফসের ওপর তালাক গ্রহণ করলে স্বামী তা মেনে না নিলে বা তালাকের ইচ্ছা না করলেও তালাক হয়ে যাবে। (আল বাহরুর রায়েক ৩/৩২৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/৩৮৭)

আকদের আগেই কাবিননামায় দস্তখত ও তাফবিজ

স্বামী যদি বিবাহের আগেই কাবিননামায় স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দিয়ে দস্তখত করে, তাহলে স্ত্রী এই অধিকারের অধিকারী হবে না। তবে যদি বিবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এভাবে অধিকার দিয়ে থাকে যে আমি তাকে বিবাহ করলে এই এই শর্তে অধিকার দিলাম, তাহলে বিবাহের পর স্ত্রী এই অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। (আদ্দুররুল মুখতার ৩/৩৪৪, আহসানুল ফাতাওয়া ৫/১৭৭)

তালাকের ক্ষমতা না দিলে জালিম স্বামী থেকে পরিত্রাণের উপায়

স্বামী যদি স্ত্রীর ভরণপোষণ না দেয় অথবা তার প্রতি অসহনীয় অত্যাচার করে এবং তালাক দিয়ে মুক্ত করে দিতেও রাজি না হয়। আবার স্ত্রীকেও তালাক গ্রহণের ক্ষমতা আগে না দিয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর তালাকে তাফবিজের ক্ষমতাপ্রাপ্তা না হওয়ায় নিজে তালাক গ্রহণ করতে না পারলে এ ধরনের অত্যাচারী স্বামী থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। এ অবস্থায় বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলে পারিবারিক আদালতে মুসলিম বিচারকের ডিক্রির মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ করাতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিচারক মুসলমান দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতিদের প্রসিকিউটর হিসেবে নিযুক্ত করে পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করাটা সবচেয়ে ভালো হয়। (আলহিলাতুন নাজিযা, আশরাফ আলি থানভি, পৃষ্ঠা ১৪৮)

উল্লেখ্য, প্রতিটি জেলার অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালত পারিবারিক আদালত হিসেবে গণ্য হয়।

লেখক : শিক্ষক

ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, বাংলাদেশ

আপনার মতামত জানান