কাতারের স্টেডিয়াম আরব-ইসলামী স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত

প্রকাশিত



আগামী ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে কাতার বিশ্বকাপ। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো আরব-মুসলিম দেশে ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করা হচ্ছে এবং একই সঙ্গে এটি শীতকালে সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ফুটবল বিশ্বকাপ। তবে প্রথমবারের মতো ৬৪টি ম্যাচ সবচেয়ে কমসংখ্যক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলেও স্টেডিয়ামগুলো হবে সৌরশক্তিচালিত পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও দৃষ্টিনন্দন। অবাক করা ব্যাপার হলো, বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়াম নির্মাণশৈলীতে রয়েছে আরব-ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর ছাপ।

মূলত প্রাচীন ও আধুনিক আরবের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতেই অভিনব এ নির্মাণ কৌশল অবলম্বন করা হয়।

১. লুসাইল স্টেডিয়াম : এটি কাতারের সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম, যেখানে ৮০ হাজারের বেশি দর্শকের একসঙ্গে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পরিচালক তামিম আল-আবিদ জানান, ঐতিহ্যবাহী ফ্যানার লণ্ঠনের আলো ও ছায়াকে ধারণ করে স্টেডিয়ামের নকশা করা হয়েছে। বাইরের খোলা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢোকা আলো ও ছায়া সন্ধ্যাবেলা পুরো স্টেডিয়ামকে আলোকিত করে। প্রাচীনকালে বন্দর থেকে জাহাজকে আলোর মাধ্যমে পথনির্দেশ করতে ফ্যানার লণ্ঠন ব্যবহৃত হতো। তা ছাড়া এর নকশায় আরব অঞ্চলের হাতে তৈরি পাত্র, বাটিসহ শিল্পকলার মূল উপাদানগুলো রয়েছে।

স্টেডিয়ামের প্রধান স্থপতি নরম্যান রবার্ট ফস্টার হাতে খোদাই করা আরব ও ইসলামী নিদর্শন নিয়ে অধ্যয়নের পর স্টেডিয়ামের নকশার মাধ্যমে প্রাচীন শিল্পের ফ্যানার ও পাত্রের উপাদানকে সংযোগ করেন। এ স্টেডিয়ামে ফাইনাল ছাড়াও একটি সেমিফাইনাল, ছয়টি গ্রুপ ম্যাচ এবং তিনটি নক আউট রাউন্ডের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। দোহা সিটি সেন্টার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। টুর্নামেন্ট শেষে এর ৮০ হাজার আসন সরিয়ে ফেলা হবে এবং বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে। বিশ্বকাপ শেষে স্টেডিয়ামে স্কুল, দোকান, খেলার স্থান, স্বাস্থ্য ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্থাপনা করা হবে।

২. আল-বাইত স্টেডিয়াম : এটি কাতারের আল খোর শহরে অবস্থিত। শহরটি মুক্তা ডাইভিং এবং মাছ ধরার জন্য বিখ্যাত। স্টেডিয়ামটি ঐতিহ্যবাহী বাইত আল-শার তাঁবুর প্রতিকৃতি হিসেবে তৈরি করা হয়। মূলত মরুভূমিতে বসবাসের জন্য কাতারের যাযাবররা ঐতিহ্যবাহী তাঁবু ব্যবহার করত। এটিতে ৬০ হাজার দর্শকের ধারণক্ষমতা আছে। এতে রয়েছে প্রত্যাহারযোগ্য ছাদ, উন্নতমানের শীতাতপ পদ্ধতি। টুর্নামেন্ট শেষে এর বেশির ভাগ আসন সরিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে। এতে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।

৩. আহমদ বিন আলী স্টেডিয়াম : মধ্য দোহা থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে শহর আল-রাইয়ানে অবস্থিত এটি। এতে দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার। এই স্টেডিয়ামটির জন্য রয়েছে একটি মেট্রো স্টেশন। স্টেডিয়ামের নকশা ও চারপাশের নির্মাণকাঠামোতে রয়েছে স্থানীয় আরব্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিশ্রণ। সামনে থাকা বালুর টিলা, জ্যামিতিক নিদর্শন, স্থানীয় উদ্ভিদ, প্রাণিজগৎ মরুভূমির সৌন্দর্যকে অপরূপ নয়নাভিরাম করে তুলেছে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিফলিত করেছে। টুর্নামেন্টের পর স্টেডিয়ামের অর্ধেক আসন বিদেশের ফুটবল উন্নয়ন প্রকল্পে দান করা হবে। এ ছাড়া আগের মতো আল-রাইয়ান স্পোর্টস ক্লাবের হোম ভেন্যু হিসেবেই ব্যবহৃত হবে।

৪. আল-থুমামা স্টেডিয়াম : দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই অবস্থিত এ স্টেডিয়াম। মধ্যপ্রাচ্যে পুরুষদের পরিহিত ঐতিহ্যবাহী ‘গাহফিয়া’ নামের টুপির আদলে তা তৈরি করা হয়। স্টেডিয়ামের ভেতরে শীতল পরিবেশ বজায় রাখতে পুরো মাঠে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভেন্ট স্থাপন করা হয়। এতে ৪০ হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। টুর্নামেন্ট শেষে ২০ হাজার আসন সরিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে। পরবর্তী সময়ে এখানে একটি বুটিক হোটেল তৈরি করা হবে এবং বিশ্বখ্যাত অ্যাসপেটার স্পোর্টস ক্লিনিকের শাখা খোলা হবে।

৫. ৯৭৪ স্টেডিয়াম : মূলত ৯৭৪টি শপিং কনটেইনার দিয়ে এ স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। সংখ্যাটি কাতারের আন্তর্জাতিক ডায়াল কোড হিসেবেও ব্যবহৃত। এই স্টেডিয়ামে ৪০ হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা আছে। টুর্নামেন্ট শেষে ২৫ হাজার আসন সরিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে। ফিফা বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিকে পুরোপুরি অপসারণযোগ্য টুর্নামেন্ট ভেন্যু হিসেবে বলা হয়েছে। সাধারণ স্টেডিয়ামের তুলনায় এতে খুবই কম উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। আগামীতে এ ধরনের স্টেডিয়াম তৈরিতে তা নমুনা হিসেবে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

৬. এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম : দোহা থেকে প্রায় সাত কিমি উত্তর-পশ্চিমে আল-রাইয়ান এলাকায় সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যখানে অবস্থিত এটি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামী স্থাপত্যের জ্যামিতিক নকশায় স্টেডিয়ামের সম্মুখভাগ ত্রিভুজ আকৃতিতে তৈরি করা হয়। বিশ্বের অন্যতম পরিবেশবান্ধব টেকসই স্টেডিয়ামটি ‘ডায়মন্ড ইন দ্য ডেজার্ট’ নামে পরিচিত। এই স্টেডিয়াম তৈরিতে ২০ শতাংশ সবুজ কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়েছে। এ স্টেডিয়ামে সারা দিন সূর্যালোকের প্রতিফলন ঘটে এবং যেকোনো দিক থেকে এর রং পরিবর্তন দেখায়। স্টেডিয়ামের কুলিং সিস্টেম থেকে শুরু করে চারপাশের সবুজ স্থানসহ সব কিছু স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়। এতে ৪০ হাজার দর্শকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। টুর্নামেন্ট শেষে ২৫ হাজার আসন সরিয়ে বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে।

৭. আল-জানুব স্টেডিয়াম : এটি আল-ওকরাহে অবস্থিত। স্থানটি সমুদ্রযাত্রা, মাছ ধরা ও মুক্তা চাষের জন্য খুবই বিখ্যাত। অতীতে স্থানীয় মুক্তা ডুবুরিরা দাও নৌকা করে সমুদ্রযাত্রা করতেন। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে বক্রাকারে স্টেডিয়ামের ছাদ তৈরি করা হয়। স্টেডিয়ামের নকশাকারী ইরাকি-ব্রিটিশ স্থপতি জাহা হাদিদ বলেন, এর বক্রাকার ছাদ এবং ভেতর ও বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্য দর্শকদের জাহাজের থাকার অনুভূতি দেবে। এতে ৪০ হাজার আসন আছে। টুর্নামেন্ট শেষে ৪০ হাজার আসন থেকে কমিয়ে ২০ হাজার করা হবে। এরপর তা বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে দান করা হবে।

৮. খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম : ১৯৭৬ সালে নির্মিত এ স্টেডিয়ামে এশিয়ান গেমস, অ্যারাবিয়ান গালফ কাপ, এএফসি এশিয়ান কাপসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকাপের জন্য তা পুনর্নির্মাণ করা হয়। দোহা মেট্রো গোল্ড লাইনের সঙ্গে এর যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। নান্দনিক এই স্থাপত্যের চারপাশে রয়েছে অ্যাস্পায়ার ডোম, অ্যাস্পায়ার পার্ক, দ্য টর্চ হোটেল আর হামাদ অ্যাকোয়াটিক সেন্টার। আধুনিক নকশায় তৈরি করা সম্মুখভাগ নজর কাড়ে সবার। স্টেডিয়ামে যুক্ত করা দ্বৈত খিলানগুলো এর ধারাবাহিকতার মূর্ত প্রতীক। এতে ৪০ হাজার আসন রয়েছে। টুর্নামেন্ট শেষে তা কমিয়ে ২০ হাজার করা হবে এবং বিভিন্ন দেশের ক্রীড়া প্রকল্পে তা দান করা হবে।

আপনার মতামত জানান