এ শুধু জয় নয়, জবাব!

প্রকাশিত

নারীর পা পেছন থেকে ধরে আছে সমাজ! হ্যাঁ, আজকের সমাজ বেশ উন্নত। আধুনিক। তাতে কী? নারীর বেলায় বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নারীর চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে পারে, চলার বলার নিজস্ব ছন্দ থাকতে পারে- সমাজ এখনও তা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। সেকেলে ভাবনা থেকে নারীর সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নারী শিরদাড়া সোজা করে দাঁড়ালে, জড়তাহীন হেঁটে গেলে, চোখে চোখ রেখে কথা বললে সমাজের বড় যাতনা হয়। প্রতিনিয়ত নারী শক্তিকে অবজ্ঞা করে পুরুষ শাসিত সমাজ।

যে কোন ছুঁতোয় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয় নারীকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় ধর্মকে। ধর্মের নামে প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠী নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে মরিয়া। মেয়েদের তারা চারদেয়ালে বন্দী করে রাখতে চায়। লেখাপড়া চাকরি ব্যবসা বাণিজ্যে নারীর সমান অংশগ্রহণ মেনে নিতে পারে না। প্রতি পদে এরা বাধার সৃষ্টি করে।

এমনকি মেয়েরা কী পোশাক পরবে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে দেখা যায় মূর্খ পুরুষদের। নারীরা কেন জিন্স পরল, কেন কপালে টিপ- চিন্তায় ঘুম হয় না তাদের! অভিন্ন ধ্যান ধারণার বিচারক এবং পুলিশ সদস্যের কথাও এখন সবার জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও পোশাক সংক্রান্ত জ্ঞান দিতে চলে আসছে ধূর্ত ধর্মব্যবসায়ীরা। মেয়েরা গান করলে, নাচ করলে বাধা আসছে। মোটরসাইকেল চালাতে দেখলে গা জ্বলছে। আরও কত কী!

এ অবস্থায় প্রতি ক্ষেত্রে বস্তুত লড়াই করতে হচ্ছে নারীকে। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য লড়াই। লড়াইয়ে জয়ী নারীরাই শুধু সামনে আসতে পারছে। এখন তাই নারীর পায়ের নিচে এভারেস্ট। একের পর এক সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করছে তারা। এবং এভাবে একই লড়াইয়ের পথ ধরে সামনে এসেছে নারী ফুটবল। এখন এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা। প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নারী শক্তির বিজয় ঘোষণা করেছে। তাদের উচ্ছ্বাস উদ্যাপন দেখে মনে হচ্ছে সাফে অপরাজিতা নারীরাই এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ।

বলার অপেক্ষা রাখে না, পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ সমাজ ও দরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা নারী ফুটবলারদের সংগ্রামটা ছিল কঠিনতর। অযুত লাঞ্ছনা গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে তাদের। মেয়েরা দর্শক ভর্তি গ্যালারিতে ফুটবল খেলবে, প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ তা মানতে রাজি ছিল না। যতভাবে সম্ভব ছোট করেছে। টিপ্পনী কেটেছে কত! নারী ফুটবলারদের নিয়ে হা হা হি হি হয়েছে রাজধানীতেও।

দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কথা নারী ফুটবলার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মুখে বারবারই উঠে এসেছে। সর্বশেষ ফাইনালের আগ মুহূর্তে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে একই অভিজ্ঞতার কথা জানান বিজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সানজিদা আখতার। ভাইরাল স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে এক পাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।

দলে পাহাড় ও গ্রাম থেকে আসা মেয়ের সংখ্যা বেশি।
সে কথা জানিয়ে তিনি লিখেন, পাহাড়ী ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলঙ্কার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব।

সত্যি লড়েছিলেন তারা। এ কারণেই এত বড় সাফল্য!
এ সাফল্যের আরও দুই সারথী সোহাগী কিসকু ও স্বপ্না রানী। দুজনেরই বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলায়। বিজয়ের পর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য সোহাগী কিসকুর বাবা গুলজার কিসকু বলছিলেন, রানীশংকৈল ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম রাঙ্গাটুঙ্গি তখন ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি চালু করলেন। সেখানে মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন তিনি। তখন সোহাগীও ফুটবল খেলে। সেখানে যোগ দিল সে। এটা দেখে কেউ বলল, মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে খেলে, লজ্জা-শরম নাই। কেউ বলল, এদের কখনও বিয়ে হবে না। এমন নানা কথা শুনতে হয়েছে আমাদের।

এক পর্যায়ে মেয়েকে ঘরে আটকে রেখেছিলেন বলেও স্বীকার করেন তিনি।
স্বপ্না রানীর দরিদ্র বাবা নিরেন চন্দ্রের কণ্ঠেও অভিন্ন বেদনা। তিনি বলছেন, আমাদের ছোট সন্তান স্বপ্না। আমি গরিব মানুষ। তাকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। ধর্মীয় ও সামাজিক বাধা ছিল আরও ভায়াবহ। স্থানীয়দের অনেকেই বলত, মেয়ে মানুষের হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলা, এটা কোন কথা হইলো? বলত, আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেন? কে বিয়ে করবে?
বিজয়ী দলের আরেক সদস্য রংপুরের মেয়ে সিরাত জাহান স্বপ্না। স্বপ্নার মা লিপি বেগম মেয়ের সাফল্যে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, স্বপ্না ফুটবল খেলুক, এটা এলাকার মানুষ ও আত্মীয় স্বজনরা চাইত না। তারা বলত, মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে? কিন্তু স্থানীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় হারুনের সহযোগিতায় স্বপ্না ফুটবল কোচিং শুরু করে। আমিও প্রথমে রাজি ছিলাম না… কেঁদে ফেলেন তিনি।

এবং এই নারী ফুটবলারই শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে দুই গোলসহ এই টুর্নামেন্টে মোট চার গোল করে সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন। সমাজকে দেখিয়েছেন বৃদ্ধাঙ্গুলি।

গোটা টুর্নামেন্টেই দুর্দান্ত খেলছিল বাংলাদেশ। এবং পাঁচ ম্যাচের সবকটিতে জয় লাভ করেছে। তবে ফাইনালের দিকে আলাদা চোখ ছিল সবার। কারণ ফাইনাল থেকে এর আগে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল। এবার কী হবে? মাঠে খেলা গড়াতেই উত্তর পাওয়া হয়ে যায়। স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারান গ্রেট সাবিনারা। স্মরণীয় জয়ের দিনে শামসুন্নাহার করেন প্রথম গোলটি। পরের দুটি গোল করেন কৃষ্ণা রানী সরকার। আর সবার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশের গোলমেশিন খ্যাত সাবিনা।

গোটা টুর্নামেন্টে দুটি হ্যাটট্রিকসহ মোট ৮ গোল করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে সমাজের কামড়ে ধরা পায়ে বাংলাদেশের মেয়েরা গোল করেছে ২৩টি। জয়ী হয়েছে তারা। জবাবও দিয়েছে সমাজকে। বাঙালী মেয়েদের পায়ের জোর সম্পর্কে এখন জানে ফুটবল বিশ্ব। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ? পিছিয়ে পড়াদের দল? ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী? কিছু কি শিখল? শিখুক বা না শিখুক সাফে অপরাজিতা নারীই এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ।
বাংলার বাঘিনীরা, আপনাদের অভিনন্দন!

আপনার মতামত জানান