এসেছে শিউলি ফোটার দিন

প্রকাশিত



শিউলি ফুটেছে। ফুটতে শুরু করেছে। জানি, ফুলপ্রেমীরা সুগন্ধী এ ফুলের জন্য বিশেষভাবে অপেক্ষা করে থাকেন। তাদের বলি, অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষ হয়েছে। বছর ঘুরে আবারও এসেছে শিউলি ফোটার দিন। অবশ্য দিনে নয়, এ ফুল রাতে ফোটে। সাধারণত বাগানে বা গাছের কাছে তখন কেউ যায় না। তবে শিউলির মিষ্টি ঘ্রাণ কাছে টেনে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। এখন মধ্যরাতে গাছের দিকে তাকালে মনে হবে সবুজ পাতার ভিড়ে টুকরো টুকরো আলো ছড়িয়ে আছে। আর মিষ্টি ঘ্রাণ তো একচুল সরতে দেবে না আপনাকে। লোকে বলে প্রিয় বস্তু বেশি দিন ধরে রাখা যায় না।

হয়তো তাই রাতের অপরূপ শিউলি সকাল হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। না, হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার এটি নয়। বরং ভোরের আলোয় দৃশ্যমান হয় শিউলি বিছানো পথ। দেখে নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের সুর বেজে ওঠে মনে, যেখানে কবি বলছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে।’ ঝরে পড়া ফুল গাছে থাকা ফুলের মতোই তরতাজা। ঘ্রাণটাও নতুন।

নাকে এসে লাগতেই স্নিগ্ধ অনুভূতি হয়। সবুজ ঘাসের ওপর সারারাত ধরে জমা হওয়া শিউলি তাই খুব ভোরে সযত্নে কুড়িয়ে নেন ফুলপ্রেমীরা। মুঠোভর্তি ফুল জীবনের অনেক অপ্রাপ্তির কথা মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়। প্রকৃতির দান বড় ভালবেসে গ্রহণ করার অপ্রার্থিব আনন্দে মন ভরে ওঠে। স্বর্গীয় অনুভূতি হয়।

কবি আবিদ আজাদ লিখেছিলেন: ‘যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি।’ কবির এমন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণের বিপরীতে আসলে কি ঘটেছিল তা আমাদের অজানা। কবি আর বেঁচে নেই। প্রেমিকার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তাও জানার সুযোগ নেই। তবে শিউলি গাছ টিকে আছে। অতো চোখে পড়ে না। তবে আছে। ফুলটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান? ঘ্রাণ নিতে চান? হাতিরঝিলে ঢুঁ মারতে পারেন। কিছু গাছের নিচে ফুল পড়ে থাকতে দেখবেন।

গুলশান লিংক রোড সংলগ্ন একটি ফুটওভার ব্রিজ থেকে নামার মুহূর্তে এমন দৃশ্য অনেকেরই চোখে পড়ছে। রমনা পার্কে যারা প্রাতভ্রমণে যান, তারও দেখতে পাবেন শিউলি বিছানো পথ। শিউলি ফুটে আছে শিশু একাডেমি চত্বরে। একাডেমির বাগানে বেশ কিছু গাছ। বছরের অন্য সময় এসব গাছের মধ্য থেকে শিউলিকে আলাদা করার প্রয়োজন পড়ে না। তবে ফুল ফুটতেই ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা গাছের নিচে ছুটে যাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পুকুর পাড়ে আছে গাছটি।

আলাদা করে বলতে হবে পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের কথা। পুরনো কম্পাউন্ডের ভেতরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই কারাকক্ষের সামনে আছে শিউলি গাছ। যে ড্রেনটি সেদিন মহান নেতাদের রক্তে ভেসে গিয়েছিল ঠিক সে পথে শিউলি ঝরে পড়ে। যেন অলৌকিক এ দৃশ্য।

শিউলির ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। বৃন্তটি কমলা রঙের টিউবের মতো দেখতে। তবে গাছটি সাদামাটা। এটি নরম, ধূসর ছাল বা বাকল বিশিষ্ট হয়। লম্বায় ১০ মিটারের মতো। গাছের পাতা ৬ থেকে ৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল প্রান্তের বিপরীতমুখী সাজানো থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শিউলি ফুটে। শুধু তাই নয়, এটি পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রধান ফুল।

ফুলটি পারিজাত পারিজাতা ও পারিজাতাকা নামেও পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গানে ‘পারিজাত’ উল্লেখ আছে। এই যেমন: ‘পারিজাতের মধুর গন্ধ পাও কি-/হায় বুঝি তার নাগাল মেলে না।’ শোনা আছে না গানটি? প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা।

পুরাণে শিউলির উল্লেখ পাওয়া যায় ‘পারিজাতিকা’ নামে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এক দেশে অপরূপ সুন্দরী এক রাজকন্যা ছিলেন। তার রূপের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বর্ণনা করবে, কার সাধ্য? অপরূপা রাজকন্যাকে সবাই নিজের করতে ব্যাকুল। কিন্তু রাজকন্যার পছন্দ সূর্যকে। দূর আকাশে জ্বলতে থাকা সূর্যকেই তিনি সবটুকু দিয়ে ভালবাসেন। অথচ কি কা-! সূর্য তা বোঝে না! সাড়া দেয় না রাজকন্যার আহ্বানে। দূর আকাশে অধরাই থেকে যায়। প্রত্যাখ্যাত হয়ে বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় রাজকন্যার।

হারানোর ব্যথা সইতে না পেরে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বেছে নেন আত্মহননের পথ। শাস্ত্র মেনে তার শরীর দাহ করা হয়। দাহ করা হয় বটে। রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। গাছে চমৎকার ফুল ফোটে। রাতে ফোটে। সকালে সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। অশ্রুবিন্দুর মতো ঝরে যায়। রাজকন্যার নামে এই ফুলের নামকরণ করা হয় ‘পারিজাতিকা।’ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এ ফুল বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য। পারিজাতিকার বৈজ্ঞানিক নাম নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস। লাতিন শব্দ নিক্টান্থেস অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। আরবর-ট্রিসটিস হচ্ছে বিষণ্ণ গাছ। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাবার পরও অল্প সময় বেঁচে থাকে বলে এমন নামকরণ। একই কারণে শিউলি গাছকে বলা হয় ট্রি অব সরো। হয়তো তাই নজরুল লিখেছেন: দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়…।

আবারও পুরাণে ফিরি। এবারের কাহিনীতে শিউলিকে আমরা পাই ‘পারিজাত’ নামে। কাহিনীটা এরকম: কৃষ্ণের দুই স্ত্রী সত্যভামা ও রক্তকামিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগান পারিজাতের ঘ্রাণে ভরে উঠুক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! তবুও কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন তিনি। এর ফুল রক্তকামিণীর বাগানেও ঝরে পড়ে সুগন্ধ ছড়ায়।

এদিকে স্বর্গের রাজা ইন্দ্র তো ঘটনা জেনে ভীষণ রেগে যান। তিনি বিষ্ণু অবতারের ওপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এ কারণে কৃষ্ণকে শাপ দেন, কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই। কোনদিন ফল আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। ঘটনা তা-ই ঘটেছিল কিনা, সেটি অন্য আলোচনা। তবে শিউলির মতো চমৎকার একটি ফুল ঠিকই পাওয়া হয়েছিল। বহুকাল ধরে সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে এ ফুল।

গ্রাম্য বালিকা, তরুণীরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিউলি কুড়াতে বের হয়। আঁচল ভর্তি ফুল থেকে একটি একটি করে নিয়ে মালা গাঁথে তারা। খোঁপা সাজায়। রাজধানী শহরেও পথশিশুরা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে মালা তৈরি করে। তার পর রাস্তায় নেমে ক্রেতা খুঁজে বেড়ায়। একটাই অনুরোধ, এদের ফিরিয়ে দেবেন না। ফিরিয়ে দিলে ওরা নয়, নিশ্চিত বলতে পারি, আপনি ঠকবেন। হ্যাঁ, শিউলি এমনই এক ফুল!

আপনার মতামত জানান