‘এক টাকা কামাই করলাম তিন টাকা খোয়াইয়া’

প্রকাশিত

 

জয়নুল আবেদীন >>
‘দেশ আগে, দল পরে, ব্যক্তি শেষে’ উক্তিটি ভারতের লৌহপুরুষ ৯১ বছর বয়সী প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি বলেছিলেন বিজেপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর। এই আদর্শ সামনে রেখে বিজেপি এবার বিপুল সাফল্যের সাথে লোকসভার নির্বাচন বৈতরণী পার হয়েছে।

আমরা প্রতিবেশী ভারতকে এত অনুসরণের পরও উক্তিটি মনে রাখতে পারিনি। কারণে-অকারণে দল ও ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ ও জাতিকে পেছনে ফেলে রাখি।
বিগত পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষ্য মতে, ২০১৪-১৫ (জুলাই-মার্চ) অর্থবছরে ৯ মাসের প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫১ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি আরো বৃদ্ধি করার জন্য অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল চার দশক আগে। প্রবৃদ্ধির নতুন উৎসের অন্যতম, বালুমহাল থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ হয় আমাদের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে। সুধীজনের মতে, বালুমহাল থেকে প্রাপ্ত লাভের অঙ্কটা যোগ করার আগে লোকসানের অঙ্কটাও খতিয়ে দেখা আবশ্যক।

জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কুমিল্লা) ১৪০০ বঙ্গাব্দে ‘নলচর মেঘনা নদী ভরাটিয়া’ ও ‘সেনের চর সাপমারা চরের গাঁও’ এই দুটি বালুমহাল সৃষ্টি করে যথাক্রমে ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১০১ টাকা ও ১৩ লাখ ৫০ হাজার ১০১ টাকা ইজারা পেয়েছিলেন। এক তদন্ত প্রতিবেদনে ইজারা বন্ধের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪১৫ বঙ্গাব্দে মহাল দুটির ইজারা বন্ধ রেখে ‘মেঘনা নদী বলুমহাল’ নামে ইজারা দেয়া শুরু হয়। বালুমহালটির ইজারা ১৪২১ বঙ্গাব্দে বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি দুই লাখ ৯৯ হাজার ৯৭৯ টাকা ৬০ পয়সা। ক্রমবর্ধমান হারে ১৪০০ থেকে ১৪২১ বঙ্গাব্দ- এই ২১ বছরের প্রাপ্ত টাকা গড় করে যোগ করলে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৬ কোটি। ‘পার্টির খরচ’সহ দলীয় লোকদের কর্মসংস্থানের বিষয় হিসেবে মাথায় রেখে ‘কাঁচা পয়সার খনি’ পরিচিত বালুমহাল যখন যারা ক্ষমতায় তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যেই কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে টেকানগর ও নলচর পুরাণগ্রাম নামে দুটি গ্রাম এবং ৯০ শতাংশ হারিয়ে গেছে রামপ্রসাদের চর ও মৈশারচর নামে দুটি গ্রামের। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে কালির চর, খাসের চর, সোনামুখী, কমলাপুর, কাউয়াটেঙি ও ডেঙুরকান্দি নামের ছয়টি গ্রাম। এখন নুনের টেক (সুবর্ণগ্রাম), রায়পুর, হাড়িয়াসহ আরো কয়েটি গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার পথে।

২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে এক পলকে মেঘনা নদীতে তলিয়ে গেল রামপ্রসাদের চর গ্রামের শতবর্ষের প্রাচীন মসজিদ, গাছপালাসহ ২৩টি বাড়ি ও ৫০ একর ফসলি জমি। ভাঙনতাড়িত এলাকায় কয়েক শ’ পরিবার বাস্তুহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে- ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টাকা। গাছপালাসহ বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ার সচিত্র সংবাদ সব জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

নলচর চর লাউয়াদি মৌজা, সাপমারা চরেরগাঁও মৌজা এবং সেনের চর মৌজার তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির আনুমানিক পরিমাণ অন্তত দেড় শ’ একর। সেনের চর মৌজায় প্রতি শতাংশ নাল জমির বর্তমান মূল্য ৩০ হাজার ১১ টাকা। দেড় শ’ একর জমির মূল্য ৪৫ কোটি এক লাখ ৬৫ হাজার টাকা। বাড়ির মূল্য আরো বেশি। উভয় ক্ষেত্রে একত্রে কম করে হলেও শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ ও সম্পত্তি তলিয়ে গেছে। আয়-ব্যয়ের হিসাবটা সোনারগাঁওয়ের বেলায় আরো বেশি। সরকারের নগদ রাজস্ব ১৬ কোটি টাকার উৎস বের করতে গিয়ে জনগণকে খোয়াতে হয়েছে কয়েক শ’ কোটি টাকার সম্পদ।
রামপ্রসাদের চরের এক পলকের ভাঙনে মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হলে হাইকোর্ট ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়। জেলা প্রশাসক কুমিল্লা ১৪১৫ বঙ্গাব্দে মহাল দুটির ইজারা দেয়া না দেয়ার বিষয়ে মতামতের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে ইজারা বন্ধের সুপারিশ করেন। সুপারিশের পরে সুকৌশলে মহালের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মেঘনা নদী বালুমহাল’।

বালুমহালে শুধু সম্পদ ধ্বংস নয়, সুখ-সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে পড়াসহ মহাল এলাকায় বাড়ছে অপরাধ। র্তীরবর্তী মানুষের সাথে ইজারাদারদের বিরোধ ছাড়াও মহালের দখল এবং টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ লেগেই আছে। গত ২৮ জুন ২০১৬ তারিখের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, ‘ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মেঘনা নদীতে বালুমহালের অবৈধ দখল নিয়ে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও খননযন্ত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়াসহ ২০ জন আহত’। এমন কোনো বালুমহাল নেই যেখানে খুন-খারাবিসহ সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ নেই। গত দুই যুগে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়েছে দুই শ্রেণীতে। এদের মধ্যে শোষিতরা আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে আর শোষকরা আরো প্রভুত্ব, বিত্তবৈভবের মালিকসহ ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠছে। শোষণের দ্বারা অর্জিত অর্থের বেশির ভাগই ব্যয় হয় দমন-পীড়ন এবং বিলাস ও শৌখিনতায়।

এলাকাবাসী বাস্তুভিটা রক্ষার জন্য আবেদন শুরু করেছিল ১৯৯৭ সাল থেকে- করা হয়েছিল হাইকোর্টে রিটও। হাইকোর্ট ‘The respondent no 1-4 are directed to restrain the respondents 5-7 from digging sand from the land outside their lease area’ মর্মে আদেশ দিলেও বিস্তীর্ণ মেঘনার তীব্র স্রোতের ওপর পৃথকভাবে বালুমহালের সীমানা চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। তাই, মৎস্য আইনের মতো, যেখানে নদী সেখানেই মহাল। দুর্বল আর সবলের খেলায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে, অর্থ ও পেশিশক্তির কাছে আমজনতা বড়ই অসহায়। শুধু অসহায়ই নয়, প্রতিবাদের পরিণাম হয় কথিত চাঁদাবাজ আখ্যায়িত করে শ্রীঘরে ঢুকিয়ে দেয়া।

বছর পাঁচেক থেকে রামপ্রসাদের চরের পাশে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় ভাঙন বন্ধ হয়ে নদীর পাড় ঢালু হয়ে পলি পড়তে শুরু করেছিল। বাস্তুহারা মানুষ শেষ সম্বল বিক্রি করে নতুন বসতি গড়ে। কিন্তু মাস কয়েক আগে নতুন গড়ে ওঠা বসতির পশ্চিম দিক দিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করতেই আবার শুরু হয় তলিয়ে যাওয়া। নতুন বসতি হারিয়ে এবার কোথায় যাবে তারা? এর মধ্যেই কয়েক একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

তলিয়ে যাওয়ার জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, দায়ী দুর্লোভের বশবর্তী হয়ে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে যারা অপরিকল্পিত বালুমহাল সৃজন করে, তারাই। সরকারের বাহবা কুড়াতে গিয়ে আটটি গ্রামসহ কয়েক শ’ একর জমি হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি, একদিন হারিয়ে যাবে সবার মন থেকেও। অসহায় মানুষের পক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কামরুজ্জামান সালামের উদ্যোগে এবার ৮ জুন রামপ্রসাদের চর গ্রামে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। চালিভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ সরকারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন মেঘনা উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ মিয়া (রতন শিকদার)। তারা জনগণের পাশে থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার করে যেকোনো মূল্যে অবৈধ ও অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম ভারতের রাজনীতিক লালকৃষ্ণ আদভানির বক্তব্য দিয়ে, শেষ করছি অখ্যাত দেওয়ান অঙ্কার উদ্ধৃতি দিয়ে। শৈশবে আমাদের অঞ্চলে সন্তান লাভসহ নানা মনস্কামনায় ‘গাজীর গান’ গাওয়ানো হতো। গাজীর গানের দলনেতার নাম ছিল অঙ্কা। তার সাথে ঢোলক, বাঁশিবাদকসহ দোহার থাকত। অঙ্কা গায়ে আলখাল্লা ও মাথায় পাগড়ি পরে দণ্ড দুলিয়ে, লম্বা পা ফেলে গান করত। ভালো খানাপিনাসহ উত্তম আদর-কদর পেলে সংসারের খবর থাকত না। গান করে ঘরে ঘরে আনন্দ দিলেও নিজের ঘরে আনন্দ ছিল না। অভাব-অনটনের সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। জীবন সায়াহ্নে অঙ্কা নিজের অঙ্ক মেলাতে ব্যর্থ হয়ে সখেদে বলে গেছেন
‘কি করলাম গাজীর গীত গাইয়া, এক টাকা কামাই করলাম তিন টাকা খোয়াইয়া’।

 

(সুত্র- নয়াদিগন্ত)

আপনার মতামত জানান