ইসলাম ও সংস্কৃতির সমন্বয়

প্রকাশিত

হোছাইন মুহাম্মদ নাঈমুল হক ও লাতিফা মিনাদি আল-কাবি



ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থার নাম। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ইহকাল ও পরকালীন কল্যাণ সাধনের নির্দেশ দেয় ইসলাম। শুধু আধ্যাত্মিকতা কিংবা জড়বাদী বিশ্বাসের নাম ইসলাম নয়। তাই আলিজা আলী ইজেতবেগোভিচ তাঁর বিখ্যাত ‘ইসলাম বিটুইন ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইসলাম এমন একটি নাম, যা বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মিকতা উভয়ের ওপর প্রযোজ্য।

তা মানুষের আচার-ব্যবহারের সুউচ্চ মাধ্যম। ’ (পৃষ্ঠা : ৫০)

খেলাধুলা ও আনন্দ-বিনোদন মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যদি তাতে ইসলামী বিধি-নিষেধের লঙ্ঘন না হয় এবং ব্যক্তি বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হয় তাহলে ইহকাল ও পরকালের জন্য কল্যাণকর এমন সব কিছুই ইসলামে অনুমোদিত। এরই দৃষ্টিকোণ থেকে দৈহিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে খেলাধুলা খুবই প্রশংসনীয়। মহানবী (সা.) নিজেও স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে দুবার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, মক্কার রুকানা বিন ইয়াজিদের সঙ্গে চারবার মল্লযুদ্ধে জিতেছেন এবং সাহাবিদের তীর নিক্ষেপে পারদর্শী হতে উৎসাহ দিয়েছেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৬৩৭; আবু দাউদ, হাদিস : ২৫৭৮)

এমনকি তিনি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বিজয়ীদের পুরস্কার দিয়েছেন এবং শিশুদের দ্রুত হাঁটার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উৎসাহ দিয়েছেন। শারীরিক অনুশীলনের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে মহানবী (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন।

তার মানে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব লক্ষণীয়। এসব ক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব তৈরিতে পেশিশক্তির চেয়ে কোমল-শক্তি (Soft Power) বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিভাষার প্রথম প্রবক্তা মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই (Joseph Nye)| এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘বাধ্যবাধকতা বা আর্থিক লেনদের বদলে আকর্ষণ তৈরির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করাই কোমল শক্তি। আর এ আকর্ষণ তৈরির অন্যতম উপাদান হচ্ছে মূল্যবোধ ও আচার-ব্যবহার। ’ যেমন তিনি বিশ্বব্যাপী আমেরিকান প্রভাব তৈরিতে শিল্প, নাটক, সংগীত, শিক্ষা, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যাপক চর্চাকে প্রধান উপকরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (সফট পাওয়ার : দ্য মিনস টু সাকসেস ইন ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ল্ড পলিটিকস, পৃষ্ঠা : ১৩-৪৬)।

সবার সঙ্গে সুন্দর আচার-ব্যবহার ও উন্নত মূল্যবোধ ধারণের নির্দেশনা দেয় ইসলাম। ইতিহাসে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কঠিন মুহূর্তে ইসলামের সুন্দর আচার-ব্যবহার দেখে অন্যরা প্রভাবিত হয়েছে। ইসলামী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদে হামলা করে মোগলরা বিজয়ী হলেও ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। টমাস আর্নল্ড (Thomas Walker Arnold) বর্ণনা করেছেন, ‘যে সময়ে ইসলামের সমর শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল সেই সময়েও তা আধ্যাত্মিক যুদ্ধে সফল হয়েছিল। ইতিহাসে বড় বড় এমন দুটি ঘটনা আছে। একাদশ শতাব্দীতে বর্বর তুর্কি সেলজুক বাহিনী নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। মুসলিম বাহিনীকে তারা পদদলিত করে পরাজিত করেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোগল বাহিনীও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হলেও উভয় শক্তি পরাজিত বাহিনীর ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। ’ (দ্য প্রিসিং অব ইসলাম, অ্যা হিস্টরি অব দ্য প্রপোগেশন অব দ্য মুসলিম ফেইথ, পৃষ্ঠা : ২৬)

ইসলামের এই আকর্ষণ শক্তির ব্যাখ্যায় ঐতিহাসিকরা দিশাহারা। তাদের কাছে এর কোনো যথার্থ ব্যাখ্যা নেই। কারণ ইতিহাসের চিরন্তন রীতি হলো, পরাজিত শক্তি সব সময় বিজয়ীদের আচার-ব্যবহার, চালচলন, পোশাক, চলাফেরাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকরণ করতে ভালোবাসে। কিন্তু ইসলামের ঐতিহাসিক কিছু ঘটনায় এর বিপরীত দৃশ্য দেখা গেছে। বিভিন্ন ঘটনায় বিজয়ীরা পরাজিতদের অনুকরণ করেছে। শুধু তা-ই নয়; বরং ধর্ম গ্রহণ করেও তারা জীবনের সব ক্ষেত্রে পরাজিতদের সব কিছু অনুসরণ করেছে। (আল-মুকাদ্দিমাহ, পৃষ্ঠা : ১৮৪)

অনেক গবেষকের মতে, ইসলামের এ আকর্ষণ ও প্রভাব শুধু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বস্তুগত উন্নতি ও অগ্রগতিতে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এ কারণে অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য পশ্চিমাবিশ্ব ইসলামের কাছে ঋণী। সেই সময় যদি ইসলাম না থাকত বর্তমান বিশ্বে আধুনিক সভ্যতার কোনো প্রভাবই থাকত না। ফরাসি নৃবিজ্ঞানী রবার্ট ব্রিফল্ট (Robert Briffault) বলেছেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আরবদের উপস্থিতি না থাকলে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা কখনো আলোর মুখ দেখত না। তারা না থাকলে উন্নতির সব স্তর উত্তীর্ণ হওয়ার সামর্থ্য রাখে এমন ‘আত্মস্পৃহা’ পাওয়া যেত না। তাই ইউরোপের অগ্রগতির সব ক্ষেত্রেই আপনি ইসলামী সংস্কৃতির গভীর প্রভাব লক্ষ্য করবেন। ’ (দ্য মেকিং অব হিউম্যানিটি, পৃষ্ঠা : ১৯০)

আলবার্ট এইচ হোরানি (Albert H Hourani) এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘উপাসনার যেকোনো দৃশ্যমান কাজের একটি সামাজিক দিক থাকে। মুসলিমরা একসঙ্গে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ে। রমজানে তাদের বার্ষিক রোজা শুধু ব্যক্তির দৈহিক অনুশীলনে ভূমিকা রাখে এমন নয়; বরং এর সামাজিক ভূমিকা অনেক বড়। তা ছাড়া সাদা কাপড়ে একই সময়ে মক্কা হজ পালনের দৃশ্যও একই প্রভাব ফেলে। ইসলামের রীতি শুধু আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বলে না; বরং মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক করার নির্দেশ দেয়। তাই ইসলাম শুধু উপাসনার বিধি-নিষেধ পালনের নাম নয়; তা পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য নিশ্চিতে সামাজিক সম্পর্ক তৈরির নির্দেশ দেয়। ’ (অ্যারাবিক থট বিয়ন্ড দ্য লিবারেল এইজ : টুওয়ার্ডস অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল হিস্টরি অব নাহদা, পৃষ্ঠা : ১২-১৩)।

মোটকথা ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবনব্যবস্থার নাম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এর সব বিধানে ইহকাল ও পরকালের সমন্বয় রয়েছে। তাই যুগে যুগে ইসলামের দৃশ্যমান নৈতিকতাবোধ ও শিষ্টাচারে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ এর ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। তবে ইসলামের এসব দিক যথাযথভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যেন মানুষ বিশুদ্ধভাবে তা যথাযথভাবে গ্রহণ করে। কারণ শক্তি থাকলেই নিজের ইচ্ছামতো তা প্রয়োগ করা যায় না; বরং এর জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা, আকর্ষণীয় নকশা ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব জরুরি। পেশিশক্তির চেয়ে কোমল শক্তির জন্য সুদক্ষ ব্যাখ্যাকার ও সুপ্রস্তুত অন্তরের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর সঠিক ব্যাখা এবং তা যথাযথভাবে গ্রহণ করা যেমন জরুরি, তেমনি নানা উপায় ও পন্থা অবলম্বন করে অন্যের মধ্যেও এর আকর্ষণ তৈরি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ আলেম-প্রাজ্ঞ ইসলামী ব্যক্তিত্বদের ভূমিকা রাখতে হবে।

ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিস অ্যান্ড সোস্যাল সায়েন্স, কাতার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত

‘তাজসির’ গবেষণা জার্নাল থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ

আপনার মতামত জানান