অর্থনৈতিক উত্তরণ, নবীজি (সা.)-এর কর্মসূচি

প্রকাশিত

মহানবী (সা.) মক্কার বৈরী পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে মদিনায় ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন করেন। তাঁর আগে ও পরে বিপুলসংখ্যক সাহাবি মদিনায় হিজরত করেন। বিপুলসংখ্যক মুহাজির মুসলিম মদিনায় আশ্রয় নেওয়ায় তা মদিনার সমাজ ও অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর বিচক্ষণতায় তা সংকটে রূপ নিতে পারেনি; বরং তাঁর দূরদর্শিতার কারণে মদিনার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল।

হিজরতের আগে ইয়াসরিবের অর্থনীতি

হিজরতের আগে ইয়াসরিবের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি ও ব্যবসা। মক্কা, বাদিয়া ও শামের সঙ্গে ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিল তাদের। তা ছাড়া কৃষিনির্ভর আরো কিছু পেশায় নিয়োজিত ছিল স্থানীয়রা। (ইয়াসিন নাজমান, তাতাওউরুল আউদাউল ইকতিসাদিয়্যাহ ফি আসরির রিসলাতি ওয়ার রাশিদিন, পৃষ্ঠা ২৬)

সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে কৃষিভূমি, কৃষিপণ্য, খেজুর, পোশাকসহ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত ইহুদিরা। মূলত তারা আরব গোত্রগুলোর বিবাদ-সংঘাতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা নিত। তারা সুদি ব্যবসাও করত। বিলাসী জীবনযাপনের জন্য আরব গোত্রীয় প্রধানরা ইহুদিদের কাছ থেকে সুদে ঋণ নিত। ঋণ-সুবিধার বিপরীতে তারা ইয়াসরিবের অর্থনীতি ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ করত। বিশেষত ইয়াসরিবের প্রধান দুই আরব গোত্র আউস ও খাজরাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত উসকে দিত তারা। (শফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম, ১৭৩-৭৪)

মদিনায় মুসলমানের হিজরত ও তার অর্থনৈতিক প্রভাব

আল্লাহর নির্দেশে মক্কার মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করার পর তাদের বাস্তু-সংস্থানের ব্যবস্থা করার সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল স্থানীয় মুসলিমদের সামনে। তখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মুসলিমদের মোকাবেলা করতে হয়। যেমন : বাজারব্যবস্থায় ইহুদি আধিপত্য, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের অবরোধ, আধিপত্য হারানোর ভয়ে থাকা মুনাফিকদের অসহযোগিতা, বিভিন্ন পেশা থেকে আসায় মুহাজিরদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারা, ইয়াসরিবের সীমিত আর্থিক সামর্থ্য ও মুহাজিরদের ক্রমবর্ধমান ধারা, মদিনার প্রধান অর্থনৈতিক খাত কৃষিতে মুহাজিররা অভ্যস্ত না থাকা ইত্যাদি। (শফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম, ১৭২)

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা

মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর প্রথমে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলায় মনোযোগ দেন। তিনি এ সময় নিম্নোক্ত কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেন।

১. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : তিনি কর্মক্ষম ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান তৈরি করেন। মদিনার মুসলিম ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবীদের সহযোগী ও অংশীদার নিয়োগ দেওয়া হয় মুহাজির সাহাবিদের। তবে মুহাজিরদের কৃষিকাজে অভ্যস্ত না হওয়ায় তাদের জন্য বিকল্প পেশা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

২. নীতিমালা প্রণয়ন : রাসুলুল্লাহ (সা.) বাজারব্যবস্থাপনায় স্থিতি ফিরিয়ে আনা এবং সে লক্ষ্যে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত বাজারে মুসলিম ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। অর্থনীতিতে স্থিতি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করেন। যেমন : মজুদদারি ও প্রতারণামূলক ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ, পণ্য বাজারে প্রবেশ ও সাধারণ ক্রেতার উপস্থিতি মূল্য নির্ধারণ, নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি।

৩. পৃথক বাজার সৃষ্টি : প্রয়োজন ছিল এমন একটি বাজার, যেখানে মুসলিমরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারবে। এ ছাড়া মহানবী (সা.) পৃথক বাজার সৃষ্টি করেন। মানুষের সমবেত হওয়ার স্থানে বড় একটি তাঁবু স্থাপনা তৈরি করেন। তিনি মুসলিম বাজারকে অবাধ ও করমুক্ত করে দেন। ফলে তা ক্রমেই জনপ্রিয় বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে। (আবদুল্লাহ, আবদুল গনি গানিম, আল-মুশকিলাতুল ইকতিসাদিয়্যাহ ওয়া নাদরিয়্যাতুল উজুর ওয়াল আসআর ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৯৯-১০০)

অন্যান্য কর্মসূচি : মুক্ত বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে মহানবী (সা.) কৃষিসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতকেও ইহুদিদের প্রভাবমুক্ত করেন। কেননা হিজরতের আগে পৃথক বিপণন কেন্দ্রের অভাবে আরব গোত্রগুলো পণ্য উৎপাদনেও ইহুদিদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গৃহীত কয়েকটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হলো,

৪. মজুদদারি নিষিদ্ধকরণ।

৫. সম্পদের উৎপাদনশীল ব্যবহারে উৎসাহ দান।

৬. ব্যবসায়ীদের স্বাধীনভাবে ব্যবসার সুযোগ দান এবং কর-রেয়াত সুবিধা প্রদান।

৭. সব ধরনের প্রতারণা নিষিদ্ধকরণ।

৮. বাজারে পণ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৯. একই ওজন পদ্ধতির প্রচলন।

১০. সুদি কারবার নিষিদ্ধকরণ। (প্রবন্ধ : উসামা আবদুল মজিদ আল আনি, রুইয়াতুন ইকতিসাদিয়্যাতুন লি-আওয়ালি ওয়াসিকাতিন সান্নাহার রাসুল (সা.) ফিল ইসলাম, আল ইসলামুল ইয়াউম, সংখ্যা ১৩)

আপনার মতামত জানান