দীর্ঘ অপেক্ষার পর মেট্রোর যুগে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত


মাঠ, মঞ্চ, মেট্রো রেল—সবই প্রস্তুত। এখন শুধু পতাকা ওড়ানোর পালা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মেট্রোর যুগে পা দিচ্ছে বাংলাদেশ। আজ বুধবার দেশের প্রথম মেট্রো রেলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোর উদ্বোধন ঘিরে সকাল ১১টায় উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরের উত্তরা পার্ক মাঠে জনসমাবেশে অংশ নেবেন তিনি। সেখানে ভাষণ শেষে মেট্রো রেলের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এরপর স্টেশনে এসে কাটবেন ট্রেনের টিকিট, ওড়াবেন পতাকা, চড়বেন ট্রেনে। প্রথম যাত্রী নিয়ে যাত্রা করবে দেশের প্রথম মেট্রো ট্রেন।


রাজধানীর নগর জীবনে স্বস্তির বার্তা নিয়ে গণপরিবহনে যুক্ত হচ্ছে মেট্রো রেল। আগামীকাল বৃহস্পতিবার যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হবে। প্রথম দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা ট্রেন চলাচল করবে। মাঝের কোনো স্টেশনে আপাতত ট্রেন থামবে না। আগামী ২৬ মার্চ থেকে সব স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে।
মেট্রো রেল চালু হওয়ায় ছোট ছোট যানবাহনের ব্যবহার কমবে। জীবাশ্ম ও তরল জ্বালানির ব্যবহার বহুলাংশে কমে যাবে। ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ হবে। মহানগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। যানজট বহুলাংশে কমবে। যানজটের কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাশ্রয় হবে।

বাসসের খবরে জানানো হয়, মেট্রো রেলের উদ্বোধন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেন, মেট্রো রেল উদ্বোধনের মাধ্যমে জনবান্ধব সরকারের আরেকটি সাফল্য অর্জিত হবে। মেট্রো রেলের যাত্রা ঢাকা মহানগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ করবে। নগরবাসীর কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হবে। মেট্রো রেল হবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি অনন্য মাইলফলক।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, দেশের গর্ব ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মেট্রো রেল বাংলাদেশের নগর গণপরিবহন ব্যবস্থায় একটি অনন্য মাইলফলক। দেশের প্রথম মেট্রো রেলের উদ্বোধন ঢাকা মহানগরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন। নগরবাসীর সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। মেট্রো রেল উদ্বোধনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সকাল ১১টায়

মেট্রোর উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মেট্রো রেল স্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, আজ সকাল ১১টা থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী ফলকের একটি প্রতিকৃতি উন্মোচন করবেন। এরপর শুরু হবে সুধী সমাবেশ। সেখানে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও জাইকার প্রতিনিধি, ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বক্তব্য দেবেন। তারপর স্মারক ডাকটিকিট ও স্মারক নোট উন্মোচন করা হবে। পরে সমাবেশস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রী উত্তরা উত্তর স্টেশনে যাবেন। সেখান থেকে মেট্রো রেল ছাড়বে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে মূল ফলক পরিদর্শন এবং স্টেশন প্রাঙ্গণে বৃক্ষ রোপণ করবেন।


ওবায়দুল কাদের আরো জানান, বৃক্ষরোপণের পর প্রধানমন্ত্রী স্থায়ী কার্ড কিনে ভাড়া পরিশোধ করে প্ল্যাটফরমে যাবেন। সেখানে অপেক্ষমাণ ট্রেনকে সবুজ পতাকা নেড়ে চলাচলের সংকেত দেবেন এবং প্রধানমন্ত্রী মেট্রো রেলে চড়ে আগারগাঁও আসবেন। সেখান থেকে চলে যাবেন নিজ কার্যালয়ে।
সব স্টেশনে ট্রেন থামবে ২৬ মার্চ থেকে

আগারগাঁওয়ে মেট্রো রেল স্টেশনে একই সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, এখন উত্তরা থেকে আগারগাঁও এসে ১০ মিনিট ট্রেনটি অপেক্ষা করবে। এই সময়ের মধ্যে সব যাত্রী নেমে যেতে হবে। এই সময়ের মধ্যেই উত্তরাগামী যাত্রীরা ট্রেনে উঠবে। তারপর ট্রেনটি উত্তরার উদ্দেশে যাত্রা করবে। বিরতিহীন যাত্রায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌঁছতে সময় লাগবে ১০ মিনিট।

সব স্টেশনে ট্রেন না থামার কারণ জানতে চাইলে এম এ এন সিদ্দিক আরো বলেন, সব স্টেশন প্রস্তুত আছে। কিন্তু মানুষের অভ্যস্ততার জন্য সব স্টেশন খোলা হচ্ছে না। আপাতত সব স্টেশনে মেট্রো থামবে না। আগামী বছরের ২৬ মার্চ থেকে সব স্টেশনে ট্রেন থামবে।

এরই মধ্যে মেট্রো রেলের ভাড়া নির্ধারণ করেছে সরকার। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার সুবিধা রাখা হচ্ছে না। এ বিষয়ে এম এ এন সিদ্দিক বলেন, কোনো হাফ ভাড়া নেই। তবে মেট্রো রেল পাস নিলে ১০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যাবে। তিন ফুটের কম উচ্চতার শিশুরা মা-বাবার সঙ্গে ভ্রমণ করলে ভাড়া ফ্রি। বর্তমান বাস্তবতায় আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে ঢাকায় মেট্রো রেলের ভাড়া বেশি নয়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মেট্রো রেল নিঃসন্দেহে ঢাকার জনজীবনে স্বস্তি নিয়ে আসবে। দ্রুত যোগাযোগ করা যাবে। তবে পুরো পথ চালু হওয়ার পর প্রকৃত সুফল ভোগ করা যাবে। তখন বাসের ওপর একক নির্ভরশীলতা কমে যাবে। এতে বাসের সেবার মান বাড়ানোর তাগিদ তৈরি হবে। ঢাকার যানজট কমবে।

ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষের যাতায়াত

মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, মেট্রো রেল পুরোপুরি চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। ছয়টি কোচসংবলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। মেট্রো রেলে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যায় যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হয়। প্রথম ধাপে চলবে ১০ সেট ট্রেন। আরো দুই সেট ট্রেন প্রস্তুত থাকবে। মাঝের চার কোচের প্রতিটিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৯০ জন। দুই পাশের ট্রেইলার কোচের (ইঞ্জিন) প্রতিটিতে সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৭৪ জন। নারী যাত্রীদের জন্য থাকছে আলাদা কোচের ব্যবস্থা।

মেট্রো রেলে একসঙ্গে অনেক যাত্রী দ্রুত পরিবহনের সক্ষমতা থাকায় সড়কের ওপর চাপ কমবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে ছোট যানের সংখ্যাও কমে আসবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে বাসের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল মিরপুর। বর্তমানে মিরপুর থেকে ৩০টি পথে প্রায় এক হাজারের মতো বাস চলাচল করে। এসব বাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি যাত্রী পরিবহন করা হয়। তবে মেট্রো রেল আংশিক চালু হওয়ায় আপাতত বাসের ব্যবসায় প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বাস মালিকরা।

বাসের যাত্রী আর মেট্রো রেলের যাত্রী আলাদা বলে মনে করছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেট্রো রেলের ভাড়া আর বাসের ভাড়া এক নয়। ঢাকায় যারা বাসে ভ্রমণ করে, মেট্রো রেলে ভ্রমণ করার সামর্থ্য তাদের না-ও থাকতে পারে। আমার মনে হয় না বাসের ব্যবসায় প্রভাব পড়বে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা আরো উন্নত হবে। বাসের সেবার মান বাড়ানোর সুস্থ প্রতিযোগিতা বাড়বে।’

মতিঝিল পর্যন্ত চালু আগামী বছর

দেশের প্রথম মেট্রো রেলের উত্তরা থেকে কমলাপুর অংশের দৈর্ঘ্য ২১.২৬ কিলোমিটার। এই পুরো পথে ১৭টি স্টেশন থাকবে। প্রথম ধাপে চালু হচ্ছে আগারগাঁও পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশ। এই পথে ৯টি স্টেশন রয়েছে। মেট্রো রেল ভাবনায় প্রথমে কমলাপুর নয়, মতিঝিল পর্যন্ত ছিল। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছর মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

মেট্রো রেলে সরকার নির্ধারিত ভাড়াকে অতিরিক্ত বলে মনে করছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, চরম দুর্ভোগের গণপরিবহন ব্যবস্থা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেবে মেট্রো রেল, এটা সত্য। মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে যেতে পারবে। কিন্তু মেট্রোর ভাড়া অতিরিক্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে অনেকে মেট্রো রেলে উঠতে পারবে না। ভাড়া অর্ধেক করা উচিত।

পরিবহন পরিকল্পনায় যুক্ত ২০১৩ সালে

রাজধানীর গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট সব কিছুর সমন্বয় করে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এই সংস্থার অধীনে ২০১৩ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। তাতে মেট্রো রেল স্থাপনের ভাবনা যুক্ত করা হয়। পরে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রো রেলের লাইনের সংখ্যা বাড়িয়ে পাঁচটি করা হয়। ঢাকায় মেট্রো রেল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ওই বছরই ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠা করে সরকার।

মেট্রো রেলের ২৪ সেট ট্রেনের নকশা প্রণয়ন ও তৈরির দায়িত্বে ছিল জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের সঙ্গে কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। ছয়টি কোচ নিয়ে একটি ট্রেন সেট গঠিত হচ্ছে। ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল জাপান থেকে মেট্রো রেলের প্রথম সেট দেশে পৌঁছে। মেট্রো রেল ও লাইনের নকশা অনুযায়ী এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে।

সব মেট্রো রেলের কাজ শেষ ২০৩০ সালের মধ্যে

মেট্রো রেল নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এতে বিদেশি অর্থায়ন ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর সরকার দিচ্ছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

ডিএমটিসিএলের আওতায় ঢাকায় মোট পাঁচটি লাইন নির্মাণ করা হবে। পাঁচ লাইনে মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য হবে ১২৯.৯০ কিলোমিটার। এর মধ্যে উড়াল পথ থাকবে ৬৮.৭৩ কিলোমিটার ও পাতাল রেলপথ হবে ৬১.১৭ কিলোমিটার। সমতলে মেট্রো রেলের কোনো পথ থাকছে না। ২০৩০ সালের মধ্যে সব মেট্রো রেলের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার।

আপনার মতামত জানান