খলিফা উসমান (রা.)-এর মানবসেবা
মানবকল্যাণ ও সামাজিক উন্নয়নে ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবনে আফফান (রা.) ছিলেন সদা নিবেদিতপ্রাণ। মুসলিমদের কঠিন দুর্যোগ ও দুঃসময়ে তিনি থাকতেন অগ্রণী ভূমিকায়। তাঁর জনকল্যাণমূলক কাজ ও দ্বিনি পথে অর্থ ব্যয়ের প্রশংসা করে রাসুলুল্লাহ (সা.) জান্নাত ক্রয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) উসমান (রা.) থেকে দুইবার জান্নাত ক্রয়ের সুসংবাদ পেয়েছেন রুমা কূপ ক্রয়ের দিন এবং সেনাদল প্রস্তুতিকালের দিন। ধনী ও দানশীল এই মহান ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় মানুষের কল্যাণে বহু সম্পদ দান ও ওয়াকফ করেছেন। তাঁর সেসব দান ও ওয়াকফ করা সম্পদ দ্বারা মানুষ এখনো উপকৃত হচ্ছে। এখানে মানবকল্যাণ ও দ্বিনি পথে তাঁর সম্পদ ব্যয়ের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
‘মসজিদ-ই-নববীর’ সম্প্রসারণে জমি ক্রয়
হিজরতের পর নবীজি (সা.) প্রথমেই নামাজ আদায়ের জন্য ছোট পরিসরে মসজিদ-ই-নববী নির্মাণ করেন। তখন মুসল্লির সংখ্যা ছিল কম। দিন দিন ইসলামের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়তে থাকায় মুসলিমের সংখ্যা বেড়ে যায়। এতে মুসল্লিদের মসজিদে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। নবীজি (সা.) চাইলেন তাঁর ধনী সাহাবিদের কেউ যেন পাশের জায়গাটি ক্রয় করে মসজিদের জন্য দান করেন। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে একদিন নবীজি সবাইকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘কে আছে নিজ উপার্জিত সম্পদ দিয়ে এই জায়গাটি ক্রয় করবে? সে দুনিয়াতে তো অন্যান্য মুসলমানের মতোই থাকবে, তবে জান্নাতে তার জন্য উত্তম কিছুর ব্যবস্থা থাকবে।’ এরপর উসমান (রা.) নিজ উপার্জিত অর্থ দিয়ে জায়গাটি ক্রয় করে মসজিদ-ই-নববীর সম্প্রসারণের জন্য দান করেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৫৫৫)
পানিসংকট দূরীকরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা
মদিনায় হিজরতের পর মুসলিমরা সেখানে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকটে পড়ে। সে সময় ‘বিরেরুমা’ বা রুমা কূপ নামে মদিনায় এক ইহুদির একটি বড় কূপ ছিল। সে এই সংকটের সুযোগে মুসলিমদের কাছে চড়া মূল্যে পানি বিক্রি করা শুরু করল। বিষয়টি জানতে পেরে নবীজি (সা.) উপস্থিত সবার সামনে ঘোষণা দিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে, যে এই কূপ ক্রয় করে মুসলিমদের জন্য ওয়াকফ করে দেবে? আর এটা যে করবে আল্লাহ, তাকে জান্নাতে একটি ঝরনা দান করবেন।’ ঘোষণা শুনে উসমান (রা.) ইহুদির কাছে কূপটি বিক্রির প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু ইহুদি তা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানাল। উপায় না দেখে উসমান (রা.) অর্ধেক কূপ বিক্রির প্রস্তাব করলেন। আর এটা এভাবে যে কূপ থেকে এক দিন ইহুদি পানি নেবে, অন্যদিন তিনি। ইহুদি এতে সম্মত হলো। উসমান (রা.) কূপ কেনার পর বিনা মূল্যে পানি বিতরণ শুরু করেন। লোকজন উসমান (রা.) নির্ধারিত দিনে পানি সংগ্রহ করত এবং পরের দিনের জন্যও পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ করে রাখত। এতে ইহুদির পানির ব্যবসায় সংকট দেখা দিলে ইহুদি পুরো কূপ বিক্রি করে দিল। উসমান (রা.) ৩৫ হাজার দিরহামের বিনিময়ে পুরো কূপের মালিকানা লাভ করেন এবং তা থেকে মুসলমানরা বিনা মূল্যে পানি নেওয়া শুরু করে। পরে সর্বসাধারণের পানি পানের জন্য উসমান (রা.) কূপটি ওয়াকফ করে দেন। (সিয়ারু আলামিন-নুবালা :২/৪৫২)
তাবুক যুদ্ধে বিপুল আর্থিক সহায়তা
তাবুক যুদ্ধে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের একজন উসমান (রা.)। তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে অধিক উট, ঘোড়া এবং হাজার হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে মুসলিমদের কঠিন সময়ে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। তাঁর উদারচিত্তে দানের এই চিত্র দেখে নবীজি (সা.) সুসংবাদ দিয়ে বললেন, ‘হে উসমান! তোমার একনিষ্ঠ এই দানের বিনিময়ে আল্লাহ তোমার নির্জনে ও প্রকাশ্যের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর তোমার এই দানের সওয়াব কিয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে।’ (ফাজায়েলে সাহাবা, হাদিস : ৭৩৬)
আরেক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন উসমান (রা.) এক হাজার দিনার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোলে ঢেলে দেন। আবদুর রহমান (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আমি সেগুলো তাঁর কোলে ওলট-পালট করতে করতে বলতে শুনলাম, ‘আজকের পর থেকে উসমান যে কার্যকলাপই করুক, তা তার কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না। তিনি কথাটি দুইবার বলেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৭০১)
চরম দুর্ভিক্ষে খাদ্য সহায়তা
আবু বকর (রা.)-এর সময়ে মদিনায় একবার অনাবৃষ্টি ও ফসল উৎপাদন না হওয়ায় চরম দুর্ভোগ দেখা দেয়। লোকজন তখন আবু বকর (রা.)-এর কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। তাই প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আল্লাহর সাহায্য কামনা করো।’
বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তাঁর কথার পর কিছু সময় অপেক্ষা করছিলাম। ইতিমধ্যে উসমান (রা.)-এর সিরিয়ায় নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা খাদ্য বা গম বোঝাই ১০০ উট নিয়ে মদিনায় উপস্থিত হলেন। এটা দেখে মদিনার ব্যবসায়ীরা উসমান (রা.)-এর দরজায় এসে তাঁদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে বলেন, আপনার মজুদকৃত খাদ্যদ্রব্য আমাদের কাছে বিক্রি করে দিন, যাতে আমরা এর মাধ্যমে অভাব কাটিয়ে উঠতে পারি। উসমান (রা.) বলেন, ‘এটা তো খুব ভালো বিষয়! আচ্ছা তোমরা আমাকে এই ব্যবসায় কত লাভ দেবে?’ তারা বলেন, যদি আপনি ১০ দিরহামে ক্রয় করে থাকেন, তাহলে আমারা দুই দিরহাম লাভ দেব। উসমান (রা.) বলেন, ‘না, লাভ আরো বেশি দিতে হবে।’ তখন তাঁরা বলেন, আচ্ছা পাঁচ দিরহাম লাভ দেব। তিনি আরো বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বললে ব্যবসায়ীরা বলেন, এর চেয়ে বেশি লাভ দেওয়া আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এরপর তিনি তাঁদের বলেন, ‘শোনো! আমি এতক্ষণ তোমাদের সঙ্গে যে দর-কষাকষি করেছি, এটা এমনিতেই মজা করেছি। এখানে যত খাদ্যদ্রব্য আছে, আমি মদিনাবাসীর অভুক্তদের মাঝে সব সদকা করে দিলাম।’ (উসমান বিন আফফান জিন্নুরাইন, মোহাম্মদ রেজা, পৃষ্ঠা ৩৬)
সংকট দূরীকরণে নবীজির বিশেষ দোয়া
উকবা বিন আমের (রা.) বলেন, নবীজির কোনো এক যুদ্ধে মুসলিমরা গভীর সংকটে পড়ে। এমনকি তাদের চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ ফুটে ওঠে। আর এটা দেখে মুনাফিকরা খুব আনন্দিত হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) এই অবস্থা দেখে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! যতক্ষণ না মুসলিমদের খাদ্যের ব্যবস্থা হবে, ততক্ষণ সূর্যাস্ত হবে না।’ আর এই যুদ্ধে দানবীর উসমান (রা.) ছিলেন। নবীজির এই ঘোষণা শোনার পর উসমান (রা.) খাদ্যবোঝাই ১৪টি উষ্ট্রী ক্রয় করে ৯টি উষ্ট্রী নবীজির কাছে পাঠালেন। কারণ তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা বলেন, তা অবশ্যই সত্য। এগুলো দেখে নবীজি ও তাঁর সঙ্গীরা অনেক খুশি হলেন। বর্ণনাকারী বলেন, সে সময় নবীজি আনন্দে উসমান (রা.)-এর জন্য এমনভাবে দোয়া করছিলেন যে আমি আগে-পরে কারোর জন্য এমন দোয়া করতে শুনিনি। তিনি দোয়ায় বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! উসমানকে দান করুন এবং উসমানের সঙ্গে উত্তম আচরণ করুন।’ (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ৭২৫৫)
সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ
আপনার মতামত জানান