ঈমান নিয়ে মাজারে যায়, ঈমান দিয়ে ফিরে আসে
ইসলামে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাসের নাম তাওহিদ। অর্থাৎ এই বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল রাখা যে, আল্লাহ হলেন এই সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র মালিক, সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালনকারী এবং রণাবেণকারী। আমাদের জীবন ও ধন-সম্পদের মালিক আমরা নই, প্রকৃত মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি এগুলো আমাদের ক্ষণিকের জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি বলুন! আমার নামাজ, আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তাই আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল’ (সূরা আনআম : ১৬২-৬৩)।
আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই (সূরা ফাতিহা : ৫)।
সন্দেহবাদীদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেন, ‘এই সম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে, যা আমি আমার বান্দার প্রতি নাজিল করেছি, তাহলে এর মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো এবং এক আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সেসব সাহায্যকারীকেও সঙ্গে নাও (যাদের কাছে তোমরা কামনা করো)। যদি তোমরা (তোমাদের দাবিতে) সত্যবাদী হয়ে থাকো’ (সূরা বাকারা : ২৩)।
হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত দুনিয়াতে যত নবী-রাসূল আগমন করেছেন, সবার জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল দুনিয়ার বুকে তাওহিদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা।
আর তাওহিদের সম্পূর্ণ বিপরীত হলো শিরক বা অংশীবাদ। অর্থাৎ ঈমান ও ইবাদতে কাউকে অংশীদার বানানো। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য ইবাদত করা, কোরবানি করা, মানত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা, অন্য কারো কাছে কোনো কিছু পাওয়ার আশা করা। এক কথায়, জীবনের সর্বেেত্র আল্লাহর দেয়া বিধান পরিহার করে মানবরচিত মতাদর্শ গ্রহণ করা।
কিন্তু আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের শিরকি কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পীর পূজা, মাজার পূজা। মাজারে গিয়ে কবরবাসীর কাছে কিছু কামনা করা। কবরবাসী কিংবা জীবিত কোনো পীরের উদ্দেশ্যে সিজদা করা। তাদের নামে জিকির করা। মৃতব্যক্তি কবরে শুয়ে মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং ইহজগতের বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা। কবরবাসীর নামে মানত করা। জীবিত পীর বা মাজারের নামে কোরবানি করা। কোনো পীর, ফকির, দরবেশকে বিপদ প্রতিহত করতে সম কিংবা কোনো কল্যাণ এনে দিতে সম বলে মনে করা। তাদের আল্লাহর রহমত বণ্টনের অধিকারী মনে করা ইত্যাদি শিরকি কর্মকাণ্ড। ঈমান বাঁচাতে হলে এসব কর্মকাণ্ড থেকে অনেক দূরে থাকতে হবে। এগুলো এমন পর্যায়ের শিরক, যা একজন মুমিন মুসলমানকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। তাওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামে অবস্থান করবে।
বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক ভণ্ডপীরের জন্ম হয়েছে। তারা মানুষের সিজদা গ্রহণ করছে। সরলতার সুযোগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নষ্ট করছে। পীর-মুরিদির নামে জমজমাট ব্যবসা খুলে বসেছে। শুধু তাই নয়, পীর-ফকিরদের নামে এখানে সেখানে মাজার স্থাপন করা হয়। মাঝে মধ্যে গায়েবি মাজার গজানোরও খবর পাওয়া যায়। এসব মাজারের বেশির ভাগই বাস-ট্রাক চলাচলের রাস্তার পাশে স্থাপিত হয়। এখনো পর্যন্ত রেল লাইনের আশপাশে মাজার স্থাপনের বা গজানোর খবর পাওয়া যায়নি। এর কারণ হলো, বাস-ট্রাক থামিয়ে মাজার কিংবা বাবার নামে যেভাবে ব্যবসা করা যায়, ট্রেন থামিয়ে সেভাবে করা সম্ভব নয়। তাই তাদের সব মাজারই গড়ে ওঠে বাস-ট্রাক চলাচলের রাস্তার পাশে। আমাদের ঈমান-আকিদা রক্ষার জন্য এ ধরনের শিরকি কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিরত থাকা এবং তাদের বিরত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে কিছু চাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘এবং তুমি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডেকো না, যারা তোমার লাভ ও তি সাধন করতে পারে না। আর যদি তাই করো তাহলে তুমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা ইউনুস : ১০৬)।
পীর-মাজারকে সিজদা করা সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ ওই জাতিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা তাদের নবীদের কবরকে সিজদার স্থল বানিয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ সা:ও এর থেকে পানাহ চেয়ে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার কবরকে প্রতিমা বানাবেন না।’ পীরের নামে কোরবানি প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘ওই সব প্রাণী যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় তা হারাম’ (সূরা মায়েদা : ৩)।
শিরক জঘন্যতম অপরাধ এবং কবিরা গুনাহ। কারণ, শিরক হচ্ছে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির রবুবিয়াতের বৈশিষ্ট্য ও গুণের তুলনা করা। সুতরাং যারা আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করল, তারা আল্লাহকে অন্যের সমান হওয়ার তুলনা করল। আর এটাই হচ্ছে বড় জুলুম। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় শিরক হচ্ছে বড় জুলুম’ (সূরা লুকমান : ১৩)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দেবো না? আমরা (সাহাবিগণ) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলে দিন। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া’ (বুখারি ও মুসলিম)।
যে ব্যক্তি শিরক থেকে তাওবা করবে না, আল্লাহ তাকে মা করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করার অপরাধ মা করেন না, তা ব্যতীত অন্য যে কোনো অপরাধ যাকে ইচ্ছা মা করবেন’ (সূরা নিসা : ৪৮)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘যে ব্যক্তি তাঁর (আল্লাহর) সাথে শিরক করবে, তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে অবস্থান করবে’ (সূরা মায়েদা : ৭২)। শিরক সব রকম নেক আমল নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তারা শিরক করত, তাদের কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যেত’ (সূরা আনআম : ৯৯)।
কুরআন-হাদিসের উপর্যুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে উলামায়ে কেরাম বলেন, মানুষ এ ধরনের মাজারে যায় তাদের ঈমান নিয়ে, আর সেখান থেকে ফিরে আসে অবচেতন মনে মূল্যবান ঈমান বিকিয়ে। কারণ সেখানে যাওয়ার আগে তার ঈমান ঠিকই ছিল; কিন্তু সেখানে গিয়ে বিভিন্ন শিরকি কাজ করে মুশরিক হয়ে ফিরে আসে।
লেখক : শিক্ষা সচিব, মাদরাসা খাতুনে
জান্নাত (রা:), ঢাকা
আপনার মতামত জানান