মাস্কের আত্মকথন

প্রকাশিত

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

আমি মাস্ক, বাংলায় মুখোশ। আদিমকাল থেকেই মনুষ্য সমাজে আমার ব্যবহার হয়ে আসছে; ইহা কখনও বিনোদনের জন্য, কখনও তস্করবৃত্তি বা ডাকাতির জন্য ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে মানুষ আমাকে ব্যবহার করে আসছে। বাংলার যাত্রাপালা, সার্কাস ইত্যাদি আমজনতার আমোদ প্রমোদের খোরাক যোগাতে আমার ব্যবহার বহুকাল যাবৎ প্রচলিত আছে। জন্তু, জানোয়ার, ভূত, প্রেত, জিন, পরীর মুখোশ পরে মানুষকে আনন্দ, ভয় শিহরণ ইত্যাদি ভাবের যোগান দিতে আমার বহুমুখী ব্যবহার অতুলনীয়। বাংলায় বহুরূপী শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে মুখোশের বহুমুখী ব্যবহার থেকে। শেক্সপিয়ার, মার্লো এবং অন্যান্য বিশ্ব বিখ্যাত কবি নাট্যকারগণ দর্শকদের বিনোদন বা মানব চরিত্রের বিচিত্র রহস্য উন্মোচনে পাত্র পাত্রীর মুখে মুখোশ বসিয়ে আসল কথা বলেছেন। আমার নিজের ওপর ধিক্কার আসে যখন দেখি আমার কারণে গরুকে আহার্য গ্রহণে বাধা দেয়া হচ্ছে। কারণ এই নিরীহ প্রাণীটির মুখে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বুনা মাস্ক বেঁধে তাকে খাদ্য গ্রহনে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লোলুপ দৃষ্টিতে খাদ্যের ভা-ের দিকে অসহায় চোখে গরুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমার চোখেও জল আসে । অবলা জন্তুটি ক্ষুধার জ্বালায় ছঁফট কওে হয়ত আমাকে অভিসম্পাত দিচ্ছে। কিন্তু আমি কি করব ! ভাবি, জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

কাপড়, সিনথেটিক বা অন্য কোন উপাদান দিয়ে মানুষ মাস্ক তৈরি করে। করোনা নামক এক অদৃশ্য অণুজীবের প্রাদুর্ভাব আজকাল এই গ্রহের তাবৎ মানুষের কাছে এক লাফে আমার আসমান প্রমাণ উঁচুতে উঠে গেছে। আগত এই আজাব যাতে মানুষের নাক মুখের কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে প্রাণ কেড়ে নিতে না পারে সে জন্যই আদম সন্তানেরা আমাকে দিয়ে আটসাঁট করে নাক মুখ ঢেকে রাখে। আপনি খালি গায়ে থাকলেও আমাকে ছাড়া চলবে না। আমার ব্যবহার মান্য করতে দেশে দেশে আইন করা হয়েছে; মুখোশ ছাড়া চললে জেল জরিমানা। ভাবলে অবাক লাগে রাতারাতি আমার সম্মান কোথায় গিয়ে উঠেছে।

কিন্তু আমার বড় কষ্ট হয় যখন দেখি, এই মহামারীর সময়েও এক শ্রেণীর বজ্জাত তাদের দোসরদের সঙ্গে মিলেমিশে আমাকে আমার মতো না বানিয়ে মুরব্বিদের হাতে বুঝিয়ে দিচ্ছে; আর সমজদাররা আমাকে মানসম্মত সিল ছাপ্পর দিয়ে মানুষ/ সেবাদান কর্মীদের মুখে ব্যবহারের জন্য ছাড় দিচ্ছে। এই চক্রের ফিসফিসানি খেলায় তাদের জীবনের সুখ শান্তি বৃদ্ধি পেলেও আমার বদনাম হচ্ছে। কারন আমাকে আমার মতো তৈরি না করায় এই দুষ্ট বিচ্ছু আমার ফাঁক ফোকর দিয়ে মানুষের শরীরে অবাধে ঢুকে সহজেই প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। যখন দেখি আমার সামনেই সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যাকর্মীরা জীবাণুর ঠোকরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে তখন আমার মুখ লুকানোর জায়গা থাকে না, আর আমার তো মুখই নাই, লুকাবো কি; নিজের ওপর ধিক্কার আসে। দুই নম্বরি মাস্কের কারণে মানুষের গাল মন্দ শুনতে হয়। প্রথম ধাক্কাটা আমার ওপর আসে, তারপর ঠিকই ভাবে এক শ্রেণীর পিশাচ ওজনদার মানুষই তাদের স্বজাতির জীবন নিয়ে আমাকে বিকৃত করে ব্যবসা করেআখের গুছিয়ে নিচ্ছে।

একটা কথা না বলে পারছি না। আপনারা আদম সন্তানরা কিন্তু বহুকাল ধরেই মুখোশের আড়ালে নাক, মুখ, চোখ ঢেকে নিজের আসল চেহারা জনসমক্ষে প্রকাশ না করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কারণ আপনারা মনে মনে যে ধান্ধা করেন মুখে এক পালিশ মসৃণ অভিব্যক্তির আস্তর দিয়ে ভিতরে সঞ্চিত রাখেন। বাইরের মুখোশটা এত সযতেœ লালন করেন যে কোন মানুষের পক্ষেই আপনার অনিচ্ছায় অন্তরে প্রবেশ করা প্রায়শই দুর্ভেদ্য ঠেকে। জায়গা মতো পর্দা সরিয়ে কাজ হাসিল করেন। মনের ভিতরে থাকা আনন্দ, বেদনা, ঘৃনা, ক্ষোভ, আক্রোশ, ল্যাঙ মারার ধান্ধা ইত্যাদি প্রবৃত্তি আপনাদের মুখোশের আবরণে ঢেকে রাখতে আপনারা বহুকালের সাধনায় ওস্তাদ হয়ে গেছেন। আপনারা কাজ হাসিলের জন্য হাসেন, কাঁদেন, মুখ ভার করেন, তোষামোদ করেন যখন যা প্রয়োজন তাই করেন। এই মুখোশের ব্যবহারে যে যত বেশি পারঙ্গম তার ভাগ্যেই তত বেশি ধন দৌলত, কুর্নিশ জোটে। এখানে কাপড়ে তৈরি মাস্কের প্রয়োজন নেই, বরং আমার ব্যবহারে আপনাদের আসল এক্টিং করতে সমস্যা হয়। জায়গা মতো হাসি কান্না, তোয়াজ ইত্যাদি লেজুড়বৃত্তির অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না।

বিধাতা অন্তর্যামী। বহুকাল যাবৎ মানুষের এই হালহকিকত দেখে করোনা নামক এই আজাবকে দুনিয়ায় নাজেল করেছেন। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ এত বেশরম, বেপরোয়া, নির্দয়, লোভী হয়ে উঠেছে যে এত দিন নিজের তৈরি মুখোশের আড়ালে মনের ভাব লুকিয়ে রাখত, স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রয়োজন মতো ভাব ধরত, এখন তারও কোন তোয়াক্কা করছে না। সৃষ্টিকর্তা তাঁর সন্তানদের এই লাগামহীন, নির্দয়, বেপরোয়া অবস্থা দেখে মনে হয় নিজেও শরমিন্দায় ছটফট করছেন। এ অবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে করোনা নামক এই আজাবকে তিনি দুনিয়ায় পাঠিয়ে মানুষকে মুখোশের আড়ালে মুখ ঢেকে রাখতে বাধ্য করেছেন। এতে একদিকে যেমন দয়াময় ঈশ্বর করোনার ছোবল হতে মানুষকে সুরক্ষা দিয়েছেন, অন্যদিকে মানুষের অমানুষ ভাব মুখোশের আবরণে আড়াল করে দিয়েছেন। সব জারিজুরি এখন বন্ধ; চাচা, আপন জান বাঁচা, এর পর যদি নাদান আদম সন্তানদের চৈতন্যেও উদয় হয়, মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, মুখোশের আড়ালে থাকা আসল মানুষের রোশনাই চোখে মুখে ফুটে উঠে। আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, অচিরেই আপনাদের শুভবুদ্ধিও উদয় হবে, মনের আলো দ্যুতি ছড়াবে মুখম-লে, অন্তরে বাইরে কোন ভেদাভেদ থাকবে না; আপনারা আমার বাঁধন মুক্ত হবেন। আমি ত জানি মুখোশ পরতে আপনাদের ফাঁপর লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে, নির্মল বায়ু সেবন এখন আপনাদের জন্য দুর্লভ, অক্সিজেন নেই। কিন্তু কি করব বলেন, এ অবস্থাত আমি সৃষ্টি করি নাই। তবে কথা দিচ্ছি, বিধাতা যদি আপনাদের উপর প্রসন্ন হন আমি আবার চলে যাব আপনাদের বাঁধন মুক্ত করে। চলে যাব আমার সেই চির চেনা যাত্রা, সার্কাস সিনেমা ইত্যাদি আনন্দ মেলায় আপনাদের বিনোদনের খোরাক যোগাতে, অন্তরকে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত করতে।

সুত্র:জনকন্ঠ

আপনার মতামত জানান