একুশের বইমেলার সময় কমায় ক্ষুব্ধ প্রকাশক ও পাঠক

প্রকাশিত

প্রতিবন্ধকতাকে পাড়ি দিয়েই শুরু হয়েছিল অমর একুশে বইমেলা। ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মার্চে অনুষ্ঠিত মেলায় ছিল মহামারীর চোখ রাঙানি। তবে সেই চ্যালেঞ্জকে সঙ্গী করেই চলছিল প্রাণের মেলা। করোনার কারণে অন্যবারের তুলনায় পাঠক-দর্শনার্থী কম হলেও পড়েনি মলিনতার ছাপ। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছিল আপন স্বরূপটি। ছুটির দিনগুলোয় বাড়ছিল পাঠকের আনাগোনা। অন্যদিকে বসন্তের পরিবর্তে চৈত্রের খরতাপে মেলা হওয়ায় মূলত দুপুর গড়ানো বিকেলে থেকে সরব থাকে মেলা। সন্ধ্যার পর ধরা দেয় বইকে ঘিরে গ্রন্থানুরাগীদের উচ্ছ্বাস আর জমাট বাঁধা আড্ডার দৃশ্যচিত্র। তবে বুধবার সন্ধ্যা নামার আগেই ঘটল ছন্দপতন। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর বন্ধ করে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। ফলে ঘর বা অফিস থেকে মেলায় এসে অনেকেই ফিরে গেছেন ব্যর্থ মনোরথে। প্রবেশ করতে পারেননি বইয়ের উৎসবে। কারণ, মেলার চৌদ্দতম দিনে আকস্মিকভাবে ঘোষণা দেয়া হয়, এখন থেকে মেলা চলবে দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনের মেলার সময়সীমা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি।

একাডেমির এই সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে লেখক, প্রকাশক থেকে পাঠকবৃন্দ। স্বাভাবিক কর্মদিবসে সাড়ে তিন ঘণ্টার মেলা হওয়ার চেয়ে না হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন প্রকাশকরা। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তারা বলছেন, এবারের মেলা হচ্ছে ১৫ লাখ বর্গফুটের বিস্তৃত পরিসরে। যথেষ্ট ফাঁকা স্থান রেখেই বিন্যস্ত হয়েছে বইমেলা। এছাড়া মেলার প্রবেশপথে রয়েছে শরীরের তাপমাত্রা মাপাসহ স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি স্টলের বিপণনকর্মী থেকে মেলায় আগত অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরিধানসহ মানছেন স্বাস্থ্যবিধি। সেই তুলনায় শপিংমল, রেস্তরাঁ, বাজার বা গণপরিবহনে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি। তাহলে মেলা নিয়ে এত টালবাহানা?

এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। আলাপচারিতায় তিনি জনকণ্ঠকে বললেন, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বইমেলা বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বাংলা একাডেমি। নীতিমালা লঙ্ঘন করে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বইমেলা পরিচালনা কমিটির নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিদিন রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা চলার কথা। কিন্তু এই অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রকাশক বা মেলার পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কোন আলাপ করেনি। লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতিকর্মীসহ নানা পেশার সম্পৃক্ত রয়েছে এই কমিটিতে। অথচ এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে তারা কারও সঙ্গে কোন আলোচনা করেনি। এর আগে শব-ই-বরাতের দিন বলা হলো, এদিন লোকজন কম আসবে তাই মেলা রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। আমরা সেটা মেনে নিলাম। অথচ পরদিন থেকে দেখা গেলে স্থায়ীভাবে মেলার সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে নয়টার পরিবর্তে রাত আটটা করা হয়েছে। আর বুধবার এক লাফে আড়াই ঘণ্টা কমিয়ে দেয়া হলো সময়সূচী। এমন মেলা হওয়ার চেয়ে না হওয়াই অনেক ভাল। এটাকে হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করছি আমরা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, এমনিতেই গতবারের তুলনায় এবার মেলায় আসছে মাত্র দশ শতাংশ মানুষ। এই দশ শতাংশের মধ্যে আবার নব্বই শতাংশই আসেন সন্ধ্যাবেলায়। এখন পুরোপুরি সন্ধ্যা নামার আগেই মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকাশকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনিতেই জনসমাগম কম ঘটায় ঠিকমতো মেলা চললেও আমাদের লোকসান হতো। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সেই লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে। এর ফলে মেলাকে ঘিরে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাসমূহের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ আরও বেশি রুদ্ধ হলো।

এ বিষয়ে কথা হয় বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদের সঙ্গে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা মেলার বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরাও চেয়েছিলাম স্বাভাবিকভাবেই চলুক বইমেলা। কিন্তু পরিস্থিতির কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাছাড়া এটা শুধু বাংলা একাডেমির একক সিদ্ধান্ত নয়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তরুণ লেখক নওশাদ জামিল বলেন, বইমেলার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময়টি হচ্ছে সন্ধ্যাবেলা। চৈত্র মাসের ভরদুপুরে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে মানুষ মেলায় আসে না। তাই বিকেলে রওনা দিলেও যানজট পেরিয়ে মেলায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বিশেষ করে কর্মজীবীদের জন্য এটি সবচেয়ে ভাল সময়। অথচ সেই জমে ওঠা সাঝবেলাতেই মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে এই সিদ্ধান্তকে অনাকাক্সিক্ষত মনে হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যায় মেলায় প্রবেশদ্বারে এসে ঢুকতে পারেননি তানিম রহমান। ক্ষোভ প্রকাশ করে এই পাঠক বলেন, কর্মজীবনের শুরু থেকে চিরকাল সন্ধ্যাবেলাতেই মেলায় এসেছি। বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ার পাশাপাশি পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছি। অথচ আজ কোন পূর্র্বাভাস ছাড়াই মেলায় এসে বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অন্তত দুইদিন আগে মানুষকে জানিয়ে দেয়া উচিত। তাহলে আর এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।

বুধবারের মেলাচিত্র ॥ এদিন দুপুর থেকেই মেলায় ছিল পাঠক বা দর্শনার্থী খরা। বিকেলের একটু একটু করে বাড়তে থাকে জনসমাগম। তবে সন্ধ্যা নামার আগেই মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশাল প্রান্তরের মেলায় বিরাজ করেছে শূন্যতা। বিরস বিদনে সময় কাটিয়েছেন প্যাভিলিয়ন থেকে স্টলের বিপণনকর্মীরা। এর মাঝে বসন্ত বিকেলে উৎস প্রকাশন থেকে হাসান শাহরিয়ার রচিত ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ নামের প্রবন্ধগ্রন্থ কিনতে দেখা যায় যায় শারমিন মুস্তাফাকে। আলাপে বলেন, গল্প-উপন্যাসের চেয়ে আমি প্রবন্ধের বই পড়তে বেশি পছন্দ করি। এই বইটি গত বছর প্রকাশিত হলেও সেই সময় সংগ্রহ করা হয়নি। আর যে বইটি পড়া হয়নি সেটিই আমার কাছে নতুন বই। সহজ ভাষায় রাজনীতি থেকে সমকালীন নানা ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ মেলে ধরা হয়েছে গ্রন্থটিতে।

নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার নতুন বই এসেছে ৯৭টি। এর মধ্যে গল্প ১৪টি, উপন্যাস ১৬, প্রবন্ধ ৫, কবিতা ৪১, গবেষণা ১, ছড়া-১, জীবনী ৩, নাটক ৩, বিজ্ঞানবিষয়ক ২টি, ভ্রমণ ১, ইতিহাসবিষয়ক ১, স্বাস্থ্য ১টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৪টি, অনুবাদ ২টিসহ অন্যান্য বিষয়ের ২টি বই এসেছে। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আগামী থেকে এসেছে মঞ্জু সরকারের উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’ এবং অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী সম্পাদিত ‘বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব স্মারকগ্রন্থ’। পালক পাবলিশার্স থেকে এসেছে রাজু আহমেদের সাক্ষাতকারভিত্তিক গ্রন্থ ‘একান্ত আলাপে সৈয়দ আবুল মকসুদ’। জিনিয়াস পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে বুলবুল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কিশোর গল্পগাথা’, ধ্রুব এষের উপন্যাস ‘আমার একজন মানুষ’ এবং ফেরদৌস হাসানের উপন্যাস ‘কে জেগে আছো’। অবসর থেকে বেরিয়েছে হায়াৎ মামুদের ‘কিশোর জীবনী নজরুল ইসলাম চিত্ররূপময় আলেখ্য’। গ্রন্থ কুটির থেকে এসেছে আয়েশা মুন্নির কাব্যগ্রন্থ ‘আবছায়ার অন্তরালে’।

সুত্র: জনকন্ঠ

আপনার মতামত জানান