বিশ্বনবী (সা.)-এর বাণিজ্যিক স্মৃতি

প্রকাশিত



পারস্য উপসাগরে অবস্থিত সৌদির উত্তর-পূর্ব উপকূলে সৌদির সঙ্গে ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘জিসর আল-মালিক ফাহাদ’ নামক ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত আধুনিক একটি রাষ্ট্রের নাম ‘কিংডম অব বাহরাইন’। মাত্র ৭৮০ বর্গকিলোমিটারের দেশটি ১৯৭১ সালে সার্বভৌম অর্জন করে। আঠারো শতকের আগে ‘বাহরাইন’ নামে আরবরা যে অঞ্চলকে জানত তা বসরা এবং ওমানের মাঝামাঝি আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চল। (আল-বাকরি, মুজাম মা উসতিজামা : ১/২৮৮)

পারস্য উপসাগরকে পূর্বে রেখে ইরাকস্থ বসরার দক্ষিণ থেকে কুয়েত, সৌদির আল-আহসা হয়ে মধ্যাঞ্চলে ‘আল-ইয়ামামার (রিয়াদ) সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাহরাইন, কাতার ও আরব আমিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করে ওমানের উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব আরবের পুরো উপকূলীয় অঞ্চলটি অন্তত ১০ শতাব্দীকাল ‘বাহরাইন’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল।

(ক্লিভ হোলস, কালচার এ সোসাইটি ইন ইস্টার্ন অ্যারাবিয়া, পৃষ্ঠা ১১)

বাইরাইনের প্রধান নগর ছিল ‘হাজার’ এবং নগরের অধিবাসী ছিল আবদুল কায়িস গোত্র। অন্য শহর ‘আল-আহসা, আল-কাতিফ, বাইসা, আল-জারাহ, আল-খাত। সেখানে প্রবাহিত হ্রদ ও মিষ্টি পানির ঝরনা আছে; প্রচুর পরিমাণে খেজুর ও ফল-ফলাদি হতো তাতে। একেকটি বাগান কয়েক মাইলজুড়ে বিস্তৃত ছিল (আল-হিময়ারি, আর-রাওদুল মুতার, ৮২)

সহিহ বুখারির স্থানগুলোর গবেষক ‘সাদ জুনাইদাল’ আরব উপদ্বীপের ভৌগোলিক ইতিহাস বিচার করে দেখিয়েছেন যে আধুনিক ‘বাহরাইন’ ও সৌদির ‘আল-আহসা’র মধ্যে একসময় স্থলসংযোগ ছিল। সময়ের আবর্তে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে স্থান দুটি আলাদা হয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন ‘আওয়ায়েল’ অংশটি ‘বাহরাইন’ এবং আরব উপদ্বীপের সঙ্গের অংশটি ‘আল-আহসা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। (মুজাম আল-আমকিনা, পৃষ্ঠা ৬২)

হাদিসের বিভিন্ন ঘটনাবলিতে ‘বাহরাইন’ ও ‘হাজার’ পরস্পরকে প্রতিস্থাপন করেছে। হয়তো হাজার-ই ছিল মূল শহর। হয়তো মুসলিম প্রাধান্যের দিক থেকে হাজার-ই ছিল অগ্রসর। হাজারের বিস্তারিত পরিচিতির আগে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে হাজারের অধিবাসীদের একটি সংলাপ শুনে নেওয়া যায়, যে পাঠে নবীজি (সা.)-এর ওই অঞ্চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে।

শিহাব ইবনে আব্বাদ বর্ণিত, নবীজি (সা.) আবদুল কায়েস গোত্রের লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি তোমাদের দেশ বহুবার ভ্রমণ করেছি এবং তা আমার সুস্পষ্ট জানা। …’ নবীজি (সা.) আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে ওই সংলাপটি করেছিলেন মদিনায়। হিজরতের পঞ্চম বছর কিংবা তারও আগে তারা মদিনায় আসেন। (আসাদুল্লাহ আল-গালিব, সিরাতু রাসুলিল্লাহ)

অন্য বর্ণনায় নবীজি (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! আমি জারারার ঝরনায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে পাথর থেকে পানি প্রবাহিত হয়। ’ (ইতহাফুল খাইরাহ, ৩০৩৩)

নবীজির (সা.) সে অঞ্চল সম্পর্কে অগাধ জানাশোনা দেখে প্রতিনিধি দলের সদস্য আশাজ বিস্মিত হয়ে বলেছিল, ‘আপনি দেখি আমাদের থেকেও আমাদের জনপদ সম্পর্কে বেশি জানেন!’ এটা একজন স্বদেশি কখন বলেন?

আবদুল কায়েস গোত্রের কাফেলাটি মদিনা থেকে ফিরে যাওয়ার পর নিজ এলাকায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে তাতে জুমা আদায় শুরু হয়। ইসলামের ইতিহাসে মদিনার বাইরে এটাই প্রথম জুমা মসজিদ। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই ইসলামে মদিনার মসজিদে নববীর পর প্রথম জুমা অনুষ্ঠিত হয় জুআসাতে। যা বাহরাইনের একটি গ্রাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৮৪৮)

আবদুল কায়েস গোত্রের সদস্য আশাজের সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর দীর্ঘ সংলাপে যেসব স্থানের নাম আসে সে সম্পর্কেও ধারণা নেওয়া যেতে পারে। তা হলো হাজার, মুশাক্কার, সাফা, জারাহ ও জুআসা। নিম্নে তার পরিচিতি তুলে ধরা হলো—

১. হাজার : এটি বাহরাইনের প্রধান শহর। বলা হয়, বাহরাইনের সব প্রান্ত-ই হাজার। (মুজাম বুলদান)

সাদ জুনাইদাল বলেন, হাজার আরব উপদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে আহসা জেলার পুরনো নাম। এখনো কেউ কেউ তাকে হাজার নামে অভিহিত করে। সেখানে খেজুরের প্রাচুর্য ও বাণিজ্যিক বাজার ছিল। প্রতিষ্ঠিত শিল্প ছিল তৈরি পোশাক, বকরির প্রক্রিয়াজাত পশম, পাথুরে বালি-কাদার হস্তশিল্প ও খেজুরের পাতাজাত নানা পণ্য। নবীজি (সা.) তাঁর মিরাজের বর্ণনায় বলেছিলেন, সিদরাতুল মুনতাহার ফল যেন ‘হাজার’ নামক স্থানের মটকার মতো। ’ (সহিহ বুুখারি, ৩৬২৩)

২. মুশাক্কার : এটি বাহরাইনের একটি দুর্গ। অথবা আল-মুশাক্কার একটি বড় শহর, যেখানে একটি দুর্গ আছে। (মুজাম আল-বুলদান; ইবনুল আরাবি)

আল-মুশাক্কারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে মুশাক্কার পাহাড়। পাহাড়ের ওপর নির্মিত হয়েছে সে দুর্গ। আল-মুশাক্কার দুটি কারণে জাহেলি যুগ থেকে বিখ্যাত। একটি ‘আইনুল মুশাক্কার’ বা মুশাক্কার ঝরনা। বর্তমানে তা আইনুল খাসিফ নামে পরিচিত। আরেকটি ‘সুকুল মুশাক্কার’ বা মুশাক্কার বাজার। প্রতিবছর জুমাদাল আখিরার প্রথম থেকে এখানে বাজার বসত। দুমাতুল জান্দাল, ওমান, ইয়েমেন এমনকি পারস্য সম্রাটের পক্ষ থেকে ব্যাবসায়িক কাফেলা আসত এ বাজারে। কাপড়, খেজুর, যুদ্ধের সরঞ্জাম বাণিজ্যের জন্য এটি আরবের বিখ্যাত বাজার। খুব সম্ভবত প্রাচ্যের ভারতবর্ষ ও চীনের দেশগুলোর সঙ্গে এ পথে আরবদের যোগাযোগ ছিল। (আলুকা ডটনেট অবলম্বনে)

৩. সাফা : এটি বাহরাইনের একটি দুর্গ বা হাজারের একটি শহর। সাফার দুর্গটি ‘হিসনুস সাফা’ নামে পরিচিত। হিসনুস সাফা দুর্গ আরবের বিখ্যাত কবি তুরাফা ইবনুল আবদের হত্যাকাণ্ডের জন্য পরিচিতি পায়। হাজারের ‘জাবালু সাফা’ পৃথিবীর যেকোনো পাহাড়ের তুলনায় অনন্য। পাহাড়টি খুব উঁচু না হলেও পুরো পাহাড়টি যেন অনেকগুলো যাত্রী চাউনি কিংবা বিশ্রামাগার। নবীজি (সা.)-এর কাছে বাহরাইনের কিছু অতিথি এলে তিনি তাদের উপদেশ দেওয়ার সময় বলেন, ‘প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া সৎকর্মকে সেভাবে নিশ্চিহ্ন করে যেভাবে সূর্য সাফার আর্দ্রতাকে মিটিয়ে দেয়। ’ (সিলসিলাতুস আহাদিস আস-সহিহা, হাদিস : ২৯৯৮)

৪. আজ-জারাহ : এটি বাহরাইনের একটি বড় গ্রাম, যেখানে ‘মারজাবানু জারাহ’ অবস্থিত। আর কারো মতে তা প্রসিদ্ধ ঝরনা। (আল-কামুস আল-মুহিত)

উপকূলীয় শহরটি খেজুর ও মাছের জন্য বিখ্যাত। এটি সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় ‘আল-আওয়ামিয়া’র উত্তরে অবস্থিত আল-কাতিফের প্রাচীন গ্রামগুলোর একটি। ‘সুকুল জারাহ’ তথা আল-জারার বাজারও এখানে অবস্থিত। পারস্য উপসাগর হয়ে এ পথে ভারত ও চীনের মতো দূর প্রাচ্যের সুগন্ধি পৌঁছে যেত।

৫. জুআসা : ‘জুআসা’ প্রাচীন বাহরাইনের গ্রামগুলোর একটি। যা আবদুল কায়সের এলাকা। এটি বাহরাইনে আবদুল কায়েস গোত্রের দুর্গ (ইয়াতুক আল-হামাভি, মুজামুল বুলদান)

নবীজি (সা.) বাহরাইনের সেই প্রতিনিধিদলের জন্য দোয়া করেন। হুদাইবিয়ার চুক্তির পর নবীজি (সা.) আল-আলা ইবন আল-হাদরামির (রা.)-এর মাধ্যমে পত্র পাঠান বাহরাইনের শাসক ‘মুনজির ইবন সাওয়া’র কাছে। তাকে অনুসরণ করে আবু হুরায়রাও (রা.) যান বাহরাইনে। মুনজির ও তার অধীনরা ইসলাম গ্রহণ করেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

আপনার মতামত জানান