জেনে নিন রমজানের শেষ দশকের ফজিলত ও ইবাদত

প্রকাশিত

আরবি ‘রমজ’ শব্দ থেকে ‘রমজান’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ ‘দহন’, জ্বলন’। আর রোজাকে আরবিতে বলা হয় ‘সিয়াম’। ‘সিয়াম’ পালনের কারণে সায়েম বা রোজাদারের পেট জ্বলতে থাকে। আর এই অবস্থা বোঝানোর জন্য আরবি ভাষায় বলা হয়, আস-সায়িমু ইয়ারমাদু তথা রোজাদার দগ্ধ হয়। এই শব্দ থেকে গঠিত হয় আর-রামাদাউ তথা উত্তাপের তীব্রতা। এই অর্থ থেকে রমজান হলো অব্যাহত তীব্র দহনের সমষ্টি।

রমজান হিসেবে এ মাসের নামকরণের কারণ হলো, রমজানের নেক আমল সব গুনাহ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়।

রোজার আরবি হলো সাওম বা সিয়াম আর সাওম বা সিয়াম অর্থ বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। সিয়াম প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৩৮)

রমজান মাসের রোজাব্রত পালন করা ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয়ের ওপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত : এ কথা সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই আর অবশ্যই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, নামাজ কায়েম করা, জাকাত আদায় করা এবং রমজান মাসের রোজা পালন করা। (বুখারি, হাদিস : ৮; মুসলিম, হাদিস : ১৬) আর রোজা এমন একটি আমল, যার মাধ্যমে নিশ্চিত জান্নাত লাভ হয় এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহর পথে যে ব্যক্তি রোজাব্রত পালন করে, আল্লাহ তার মুখমণ্ডলকে জাহান্নামের আগুন থেকে সাত বছরের দূরত্বে নিয়ে যাবে। (বুখারি, হাদিস : ২৮৪০; মুসলিম, হাদিস : ১১৫৩)

এ ছাড়া রমজান মাসের সবিশেষ গুরুত্বের অন্যতম কারণ হলো, এ মাসে জ্ঞানের আকরগ্রন্থ আল-কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়, যেটি গোটা মানবতার পথনির্দেশক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘রমজান সে মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মানবজাতির পথনির্দেশিকা, সঠিক পথের স্পষ্ট প্রমাণ ও ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) হিসেবে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য মহামূল্যবান। এই মাস প্রাপ্তিতে পরকালীন চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য মুমিনমাত্রই অবিমিশ্রিত আমল করে। প্রথম ১০ দিনে আল্লাহর রমহতে বান্দা নিজেকে পূততায় সিক্ত করে নেয়, দ্বিতীয় ১০ দিনে ক্ষমা লাভের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয় আর শেষ ১০ দিনে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা লাভের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। এ জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল রমজানের শেষ ১০ দিনের প্রতি অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন এবং নানা নফল ইবাদতের দ্বারা শেষ ১০ দিনকে সমৃদ্ধ করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে (ইবাদত-বন্দেগিতে) যে পরিশ্রম করতেন, তা অন্য কোনো সময় করতেন না। (মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫, তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৬)

হজরত আলী (রা.) বলেন, রমজানের শেষ ১০ দিনে রাসুল (সা.) (ইবাদত-বন্দেগি করার নিমিত্তে) তাঁর পরিবারবর্গকে (রাতে) জাগিয়ে দিতেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ : ৬/২৫৬)

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুল (সা.) যখন রমজানের শেষ ১০ দিনে প্রবেশ করতেন, তখন রাতে জীবিত থাকতেন, পোশাক-পরিধেয় বেঁধে নিতেন এবং পরিবারবর্গকে (ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য) জাগিয়ে রাখতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৪, মুসলিম, হাদিস : ১১৭৪)

আমাদেরও রমজানের শেষ দশকে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া চাই সবিশেষ বিজোড় রাতগুলোতে। কারণ এ রাতগুলোতেই আছে হাজার বছরের সেরা রজনী লাইলাতুল কদর, যেটি কোরআন নাজিলের মতো মহা-অর্জনসমৃদ্ধ। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর বাণী হলো, ‘যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও ইহতিসাবসহ কদররাত ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাল, তার আগের জীবনের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৯০১)

অধিকন্তু ২৭তম রাতকেই মুসলিম সমাজ কদরের রাত হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কারণ হজরত বিলাল (রা.), হজরত উবাহ (রা.), মুআবিয়া (রা.)সহ বেশির ভাগ সাহাবার বর্ণনা সপ্তবিংশ রাতকেই নির্দেশ করে। তবে আল্লাহর রাসুল (সা.) উম্মাহর মহাকল্যাণার্থে নির্দিষ্ট করে দেননি। তাই আমরা সব বিজোড় রাতে আল্লাহর রাসুলের শিখিয়ে দেওয়া দোয়া দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইব। আর তা হলো, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন কারিম তুহিব্বুল আফওয়া ফা‘ফু আন্নি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি মহাসম্মানিত ক্ষমাশীল, ক্ষমাই আপনার পছন্দ। অতঃপর আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৫১৩)

শেষ ১০ দিনের আরেক মহামূল্যবান আমল হলো ‘ইতিকাফ’ তথা ইবাদত-বন্দেগির নিমিত্তে নিয়ত করে মসজিদে অবস্থান নেওয়া। কোরআন যে ইবাদতের কথা উদ্ধৃত করেছে। এটি এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল যে আল্লাহর রাসুল (সা.) হজরত উমর (রা.)-কে জাহিলি যুগের ইতিকাফের মানত ইসলাম গ্রহণের পর পূরণ করতে বলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে, নবী (সা.) ইন্তেকাল অবধি প্রতিবছরই ইতিকাফ থেকেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণীরাও ইতিকাফ পালন করতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৬; মুসলিম, হাদিস : ১১৭২)

আসুন, গোটা রমজান সবিশেষ শেষ দশকের প্রতিটি দিন সিয়ামে আর রজনীগুলো কিয়াম তথা তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকার দিয়ে কাটাই, যাতে আল্লাহর মাগফিরাতসহ সন্তুষ্টি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা হয়ে জান্নাত লাভ করতে পারি। আমিন।

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ

আপনার মতামত জানান