গুজব

প্রকাশিত


দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়া একটি বাজপাখির যাত্রাপথ দাবি করে একটি ম্যাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ম্যাপের ছবির সঙ্গে নানা তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।


সেসব পোস্টে দাবি করা হয়, ‘একটা বাজপাখি সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় তার শরীরে কিছু ইকুইপমেন্ট বসানো হয়, আর এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইট থেকে তার যাত্রাপথ। পাখিটি ৪২ দিনে এই ১৫,০০০ কিলোমিটার পথ উড়ে পারি দিয়েছে, গড়ে প্রতিদিন ৩৫৭ কিমি উড়েছে প্রায় সমান্তরালভাবে।…’

দাবিটির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, এটি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক রেড্ডিট, ৯ গেগসহ ভারতীয় গণমাধ্যম ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হয়ে আসছে।

এসব ওয়েবসাইটের দাবি অনুযায়ী, পাখিটি একটি ফ্যালকন বা বাজপাখি। পাখিটির গায়ে একটি স্যাটেলাইট ট্রেকিং সিস্টেম বসিয়ে দেওয়া হয় এবং এটি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে ৪২ দিন ১০ হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে ফিনল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছায়। এ সময় পাখিটি প্রতিদিন ২৩০ কিলোমিটার করে পথ অতিক্রম করে।

এসব ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে পাখিটির গায়ে কে স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং সিস্টেম বসিয়েছিল এবং এর ভ্রমণসংক্রান্ত তথ্যগুলো কীভাবে পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি।

পরে দাবিটি নিয়ে অধিকতর যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে নাইজেরিয়ার গণমাধ্যম মেন্ডি নিউজে চলতি বছরের গত ১৪ মার্চ একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। তা থেকে জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত বাজপাখির যাত্রাপথ দাবি করে ছড়ানো ম্যাপটি ২০১৫ সালে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায়।

২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি কমিউনিটি ফোরামের পোস্টে দাবি করা হয়, বাজপাখিটি ওই বছরের ২০ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার রেটিজ থেকে যাত্রা শুরু করে একই বছরের ২ জুন ফিনল্যান্ডে পৌঁছায়। তবে সেখানে কোনো তথ্যসূত্র ছিল না। তথ্যটি যিনি শেয়ার করেন, তিনি সেটি ইমেইলে পেয়েছেন বলে দাবি করেন।

এরপর ধারাবাহিকভাবে ২০২০, ২০২১ ও ২০২৩ সালেও এটি একইভাবে ছড়ায়। তবে পরের পোস্টগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট বছরের উল্লেখ ছিল না। এছাড়া শুরুর দিকে পাখিটিকে ইউরোপীয়ান হানি বাজার্ড হিসেবে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে এটিকে ফ্যালকন বা বাজপাখি হিসেবে প্রচার করা হয়।

মেন্ডি নিউজের বরাতে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক ওয়েবসাইট এসএ পিপলে ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে পাখিটির যাত্রাপথ দাবি করে প্রচারিত ম্যাপটি খুঁজে পাওয়া যায়।

এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সোমালি টেকটনিক প্লেট (যার একটি ফল্ট লাইন দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হয়ে ডারবান দিয়ে বের হয়ে গেছে) ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। এটি এক সময় আফ্রিকাকে আলাদা করে নতুন একটি মহাদেশ গঠন করবে। আলোচ্য ম্যাপটি সেই ফল্টলাইনেরই দৃশ্যায়ন।

প্রতিবেদনটিতে যুক্ত এই ম্যাপের নিচে লেখা হয়, কাকতালীয়ভাবে ফল্টলাইনের এই ম্যাপকেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত পাখির গতিপথ বলে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

এসব বিশ্লেষণ থেকে প্রতীয়মান হয়, বাজপাখির দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার যাত্রাপথ দাবি করে প্রচারিত তথ্য দীর্ঘ সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে প্রচার হয়ে আসছে। এই দাবিতে ব্যবহৃত ম্যাপের ছবিটিও ভিন্ন ঘটনার, যার সঙ্গে দাবির কোনো সম্পর্কই নেই। এটি পুরোটাই গুজব।

সিদ্ধান্ত
৪২ দিনে ১৫ হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে বাজপাখির দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে পৌঁছার দাবি করে ম্যাপসহ নানা তথ্য দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে অনুসন্ধানে উক্ত দাবিতে প্রচারিত তথ্যের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায়নি। উক্ত দাবিতে প্রচারিত ছবিটিও আফ্রিকা মহাদেশের ভৌগোলিক সোমালি টেকটনিক প্লেটের ফল্ট লাইনের ম্যাপ। অর্থাৎ দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

আপনার মতামত জানান