লোহাখোর সুফি মিজানের অজানা কাহিনী

প্রকাশিত

বিশেষ প্রতিনিধি :
আজকের বিশাল শিল্প বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সুফি মিজানের উত্থানপর্বের যাত্রা ছিল সীতাকুন্ড-মীরেশ্বরাইয়ে, উপকূলীয় দানব হিসেবে। তবে এক ডকুমেন্টারি ফিল্মের সুবাদে রাতারাতি বিশ্বজুড়ে তার লোহাখোর নামের বিকৃত, বিদঘুটে পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।

সুফি নামে পরিচিত মিজান মেয়াদোত্তীর্ণ শীপ কিনে বিপজ্জনক, অবৈধ লোহা বাণিজ্যের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প আখ্যা দিয়ে তিনি খুব অমানবিক একটা ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন দেশের চট্টগ্রাম উপকূলে।

পৃথিবীর কোনো দেশ যে কাজটা করে না তাদের পরিবেশ দূষণ হবে বলে, কিন্তু সুফি মিজান সেই কাজটি করেন শিল্প নাম দিয়ে। অর্থ উপার্জন হলেই সেটাকে শিল্প বলা যায় না- তাহলে ছিনতাই ডাকাতির অপরাধও শিল্প হিসেবে মর্যাদা পেতো- এটা বুঝতে চান না সুফি মিজান সিন্ডিকেট। ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে, শ্রমিকদের মৃত্যুকূপে ঠেলে দিয়ে জাহাজ কাটার নিষিদ্ধ কর্মকান্ডকেও শিল্প কর্ম হিসেবে দেখতে চান সুফি মিজান ও তার সিন্ডিকেট।

একেকটি জাহাজ মূলত এক একটি আন্তর্জাতিক বর্জ্য। শুধু ভয়াবহ পরিবেশ দূষণই নয়, এই কাজ করতে যে পরিশ্রম হয় তা রীতিমত অমানুষিক। ভারী শিকলের চাপে কাধে ঘা হয়, হাতে ঘা হয়। লোহার কারণে ইনটক্সিকেশন হয়। উত্তরবঙ্গের অভাবী মানুষগুলোকে ব্যবহার করা হয় এ কাজে। এদের ঠিকমত বেতন দেওয়া হয়না। কৌশলে বেতন আটকে রাখা হয় যাতে এরা একবার বাড়ি গেলে পাওনা টাকার জন্য হলেও আবার ফিরে আসে। এসব তথ্য উঠে এসেছে “লোহাখোর” নামের একটি শর্ট ফিল্মে।

এই ফিল্মে সূফী মিজানের একটি সাক্ষাৎকারও আছে। যেখানে তিনি বলেছেন, এই মানুষ গুলি তার আপন মানুষ। সে এদের ভালবাসে। এরা তার কর্মচারি নয়। সুফি মিজানের নেতৃত্বে নিষিদ্ধ জাহাজ কাটার অপকর্মকে কেন্দ্র করে ডকুমেন্টারি ফিল্ম পর্যন্ত তৈরি হয়। ফিল্মটির নাম: আয়রনইটার (লোহাখোর), পরিচালক ছিলেন শাহীন দিল রীয়াজ। ডকুমেন্টারি ফিল্মটি মাত্র তিন মাসের মধ্যে বিশ্বের ১৩০টি দেশে প্রদর্শিত হলে দুনিয়াজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। সে বছরই আয়রন-ইটার আন্তর্জাতিক মানের ১১টি পুরস্কারে ভূষীত হয়।

উল্লেখ্য, লোহাখোর সুফি মিজান সিন্ডিকেটের জাহাজ কাটা অপকর্ম ও শ্রমিকদের উপর নির্দয়-নির্মমতা চালানোর বিষয়কে মূল উপজীব্য করেই অতি-সংগোপনে আয়রনইটার ফিল্ম নামের ডকুমেন্টারিটি নির্মিত হয়। ওই ফিল্মে লোহাখোর সুফি মিজানের আস্তানায় তার অমানবিক কর্মকাণ্ডের কিছু দৃশ্যাবলীও ব্যবহৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ও জ্বালানি সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ইতিপূর্বে জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও বিশেষজ্ঞদের দেখানো হয় ‘লোহাখোর’ প্রামাণ্যচিত্রটি। এতে উঠে আসা বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের করুণ পরিস্থিতি, বঞ্চনা এবং সেখানে পরিবেশের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করার ভয়ংকর দৃষ্টান্ত দেখে বিশেষজ্ঞরা আঁতকে ওঠেন। সুফি মিজান ও তার সিন্ডিকেট সদস্যদের মতো শিল্প বাণিজ্য হোতাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না করার ব্যাপারে তারা সরকারকে দোষারোপ করে তীব্র সমালোচনা করেন। এতে সুফি মিজানদের অপকর্মের দায় চাপে সরকারের উপর, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়। তারপরও চিহ্নিত লোহাখোরদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে সরকার অজ্ঞাত কারণে নির্লিপ্ত থেকেছে।

সুফি মিজান ও তার সিন্ডিকেট সদস্যদের অপকর্মের প্রামাণ্যচিত্র সংবলিত আয়রন-ইটার দেখার পর ইউরোপীয় সংসদেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সংস্থাটির পক্ষ থেকে দ্রুত অবস্থা পরিবর্তনের জন্য জোর দিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রস্তুত করা হয়? ওই সময় বাংলাদেশে পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) এই শিল্পে পরিবেশের প্রতি অবজ্ঞা করার বিরুদ্ধে আইনগত লড়াইয়ে উপনীত হন? সংস্থাটির প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। কিন্তু তাতে কী? চট্টগ্রাম উপকূলে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে বিদ্যমান বেহাল অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি মোটেও।

শাহীন দিল-রিয়াজ ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম উপকূল অঞ্চলে জাহাজ কাটার পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড এবং সেখানকার শ্রমিকদের চরম ঝুঁকিতে ফেলার বিষয়াদি নিয়ে নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র আয়রনইটার (লোহাখোর)। এই প্রামাণ্যচিত্রের জন্য তিনি ২০১০ সালে আডল্ফ গ্রিমে পুরস্কার লাভ করেন এবং ডুইসবার্জার ফিল্মওখে থেকে দর্শক পুরস্কার লাভ করেন।

শাহীন দিল আফরোজ তার ফিল্মটির বিষয়ে নিজে যা মূল্যায়ন করেন: “যদি তুমি সত্যিই ক্ষুধার্ত হও, তাহলে তুমি যেকোনো কিছু খেতে পারবে, এমনকি তা লোহা হলেও”। ছবিটির জন্য আমার গবেষণার সময় চট্টগ্রাম উপকূলে পিএইচপি-ইয়ার্ডে ৫২ হাজার টন ভারী তেলের ট্যাঙ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে একজন শ্রমিক কথা বলেছিলেন। তার নাম সোলায়মান। তিনি জানান, কোনরকম কেমিক্যাল বা প্রযুক্তি জ্ঞ্যান ছাড়াই বিশাল বিশাল জাহাজের তেল ট্যাঙ্কার, গ্যাস স্টোরসহ বিপজ্জনক ক্ষেত্রগুলোতে রাত দিন কাজ করানো হয়। নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা থাকে না। এসব কাজ চলাকালে প্রায়ই ছোট বড় দুর্ঘটনার শিকার হন শ্রমিকরা। কখনও কখনও আকস্মিক আগুন ধরে অনেক শ্রমিক ট্যাঙ্কারে আটকে পড়েন, সেখানেই তাদের জীবনের করুণ সমাপ্তি ঘটে।

সোলায়মান বলছিলেন, জাহাজ কাটার কথিত বাণিজ্যের মালিকানায় খুবই প্রতাপশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকে, থানা-পুলিশ, আইন- সবকিছুই তাদের আজ্ঞাবহ থাকে। ফলে অনিরাপদ অবস্থায় অসতর্কতার ভয়াল দুর্ঘটনায় ডজন ডজন শ্রমিক মারা গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ২/১ জনের বেশি স্বীকার করা হয় না। সরকারি সংস্থাগুলোও এসব বাণিজ্য হোতাদের সুরে সুর মিলিয়ে অভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ভাগ্য বিড়ম্বিত অভাবী পরিবারের মানুষজন শুধু দু‘মুঠো খাবার জোটাতে এসে নিজেদের জীবন হারালেও তাদের পরিবার পরিজনরা বিন্দুমাত্র ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত পান না।

প্রচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গেই সোলায়মান বলেন, ক্ষতিপূরণের টাকা মেরে মেরে লাশগুলোর উপরেই সুফি মিজানরা পিএইচপি ফ্যামেলী গড়ে তোলেন। সোলায়মানের মতো, দেশের উত্তরাঞ্চলে বার্ষিক দুর্ভিক্ষের কারণে বিপুল সংখ্যক কৃষক তাদের জন্মভূমি ছেড়ে এসব শিপইয়ার্ডে মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্র সৈকতের ত্রিশ গজের মধ্যে রাত দিন তারা বিপজ্জনক কাজে নিয়োজিত থাকে। তারা পশ্চিমা বিশ্বের আবর্জনা ভেঙে ফেলে, তেল ট্যাঙ্কার, বিশাল কন্টেইনার এবং যাত্রীবাহী জাহাজ।

আপনার মতামত জানান