কে এই নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী

প্রকাশিত

বরগুনার সাধারণ মানুষের কাছে দুই আতঙ্কের নাম নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজী। মাত্র ২৫ বছর বয়সী দুই যুবকের চরম নৃশংসতা ৩ দিন ধরে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখছে সারা দেশের মানুষ। নয়ন বন্ড আজ সকালে র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

এরাই দিনের আলোয় ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে রিফাত শরীফকে (২৫)। স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি স্বামীকে (রিফাত শরীফকে)।

দেশজুড়ে ভাইরাল হওয়া এই হত্যার ভিডিওকে কেন্দ্র করে সবার এখন একটাই প্রশ্ন, কে এই নয়ন এবং রিফাত? বরগুনার সাধারণ মানুষের কাছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, হামলা আর লুটপাটের আরেক নাম নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী।

‘০০৭ বন্ড গ্রুপের’ প্রধান নয়ন বন্ড : সহযোগী সন্ত্রাসীদের নিয়ে গঠন করা একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম ‘০০৭ বন্ড গ্রুপ’। এই গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজী আর লিডার হচ্ছে সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড।

জেমস বন্ডের আদলে গড়া এই সন্ত্রাসী গ্রুপের শেষ শব্দ বন্ডের সঙ্গে মিলিয়েই নিজের নামের পেছনে বন্ড লাগিয়েছে নয়ন। এই গ্রুপের একটি ফেসবুক গ্রুপও আছে।

রিফাত শরীফকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার আগের রাতে এই ফেসবুক গ্রুপেই হত্যার সর্বশেষ নির্দেশনা দেয় রিফাত ফরাজী। সেখানে গ্রুপের সবাইকে ২৬ জুন বুধবার সকাল ৯টার মধ্যে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়। মোহাম্মদ নামে একজনকে সকাল ৯টায় আসার সময় রামদা নিয়েও আসতে বলে সে।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ০০৭ বন্ড নামের সন্ত্রাসী গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা নয়ন বন্ড। যার বাসা বরগুনা পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডে। বাবা মৃত সিদ্দিকুর রহমান। নয়নের বড় ভাই মিরাজ সিঙ্গাপুর প্রবাসী। মাকে নিয়ে ওই এলাকায় নিজেদের বাড়িতে থাকে নয়ন।

ছোটবেলা থেকেই সন্ত্রাসী এবং মাদকসেবীর খাতায় নাম লোখানো নয়ন বহুবার জেল খেটেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টায় বাসায় হানা দিয়ে তাকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।

এক সহযোগীসগহ গ্রেফতার হওয়া নয়ন বন্ডের বাসা থেকে এসময় বিপুল পরিমাণ মাদক ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় দীর্ঘদিন জেল খেটে অতিসম্প্রতি বের হয় নয়ন। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই সে সহযোগীদের নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করল রিফাত শরীফকে।

বরগুনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবীর হোসেন মাহমুদ জানান, ‘নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে মাদক, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী এবং ছিনতাইয়ের ১০টি মামলা রয়েছে। বহুবার আমরা তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে জামিন নিয়ে সে আবার বের হয়ে আসে।’

জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ওই শীর্ষ নেতার ছত্রছায়ায়ই মূলত নিজের সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলে নয়ন বন্ড। এমনকি রিফাত শরীফকে হত্যার পর ওই নেতা নয়ন বন্ডকে ছাত্রলীগের কর্মী বলেও গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যদিও তা অস্বীকার করে পাল্টা বিবৃতি দেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আদনান হোসেন অনিক।

প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থাকায় তাদেরকে কেউ কিছু বলারও সাহস পেত না। বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন জানান, ‘রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামি নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজীকে গ্রেফতারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’

৮ মামলার আসামি রিফাত ফরাজী : বরগুনা পৌর শহরের ৪নং ওয়ার্ডের দুলাল ফরাজীর ছেলে রিফাত ফরাজী। অবশ্য আরও একটি পরিচয় আছে তার। সে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক এমপি এবং বর্তমানে বরগুনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের আপন ভাগ্নে।

বরগুনা থানা পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী হামলা, ভাংচুর, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে মোট ৮টি মামলা রয়েছে রিফাতের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময়ে এসব মামলায় বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হয় সে। তবে আইনের ফাঁক গলে প্রতিবারই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আবারও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে সে।

পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা-ভাংচুরের অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে রিফাতের বিরুদ্ধে।

বর্তমানে বরগুনায় কর্মরত পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি বরগুনায় কর্মরত থাকাবস্থায় এক দিন রিফাত তার সহযোগীদের নিয়ে আমার বাসার আঙ্গিনায় হৈচৈ করছিল। আমার স্ত্রী নিষেধ করলে ক্ষেপে গিয়ে দলবল নিয়ে আমার বাসায় হামলা চালায় সে। বাসার ভেতরে ঢুকে আমার স্ত্রীকে লাঞ্ছিত এবং ভাংচুর চালায়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কিছুদিন পর জেল থেকে বের হয়ে আবার শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।’

ধানসিঁড়ি রোড, কেজি স্কুল রোড এবং ডিকেপি রোডের বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে একদিকে ভীত এবং অন্যদিকে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার মানুষ।

২০১৭ সালের ১৫ জুলাই তরিকুল (২১) নামে প্রতিবেশী এক যুবককে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে রিফাত। সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে হত্যার হুমকি দেয়ার পর দেড় মাস পালিয়ে থাকে তরিকুল। দেড় মাস পর তাকে পেয়ে কুপিয়ে জখম করে রিফাত।

রিফাত ফরাজী সম্পর্কে জানতে চাইলে তার মামা বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আরও দুই বছর আগে ভাগ্নে রিফাত ও তার পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ওই পরিবারের সঙ্গে আমার বা পরিবারের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে, রিফাত আমার কাছ থেকে কোনো রকম কোনো সহযোগিতা পেয়েছে তাহলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব।’

আপনার মতামত জানান