আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ – বঙ্গবন্ধু
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে ৫ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক একটা দিন।
‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দীর্ঘ ইতিহাসে ‘বঙ্গ’, ‘পূর্ব বঙ্গ’ ‘পূর্ব বাংলা’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ইত্যাদি নামেই পরিচিত ছিল বাংলাদেশ। নামের এ দোদুল্যমান অবস্থা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, পঞ্চাশের দশক থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম নিয়ে প্রতিবাদ করে আসছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৭ সালে করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটির প্রতিবাদ করেন। গণপরিষদে প্রতিবাদ করে দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। সেটা আপনারা মুছে ফেলতে পারেন না। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা, এজন্যই গণভোট নিতে হবে।’
পঞ্চাশের দশকে একদম শুরুর দিকে ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তখন থেকে ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, বাংলাদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করছিলেন। আকার-ইঙ্গিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা বলছিলেন।
ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতার স্বপক্ষে আরও সরব হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬২ সালে শেখ মুজিবের গোপন নির্দেশে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস নামে ছাত্রলীগের একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন। তখন অবশ্য তারা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশকে বলতেন ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।” আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন। ইতিহাস অনুযায়ী, সেদিনই প্রথম পূর্ব বাংলা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে আনুষ্ঠানিকভাবে নামকরণ করা হয়।
‘বাংলাদেশ’ নামকরণের ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বলেছিলেন, “একসময় দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
বাংলাদেশ নামকরণ করেছেন যিনি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি যিনি, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ নাম দিয়ে অনেকেই তাকে অপমান-অসম্মান করেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ কিংবা ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নাম মুছে ফেলা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে তার প্রায় সব ভাস্কর্য, স্মৃতিস্মারক। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাসভবন।
অনেক কিছু হয়ত ‘রিসেট বাটন’ ক্লিক করে মুছে ফেলা যাবে, ডিলিট করা যাবে, তবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার ধারক-বাহকরা কি বাংলাদেশ নামটা পরিবর্তন করতে পারবেন? বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে পারবেন?
জেনে রাখুন, বাংলাদেশ নামকরণ করেছেন শেখ মুজিবুর রহামান। নামকরণ শুধু নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে মুছতে গেলে দেশের নাম ও ইতিহাস মুছতে হবে। বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন করতে হবে, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে হবে। আপনারা তা কোনোদিন পারবেন না। অতএব, ভুল স্বীকার করুন, সত্য যত কঠিন হোক, ‘কঠিনরে মানিয়া লও’।
লেখক : সাংবাদিক


আপনার মতামত জানান