জানা গেছে কি কারণে দস্যুরা অত্যাচার কম করেছে
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সোমালিয়ান জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত বাংলাদেশি ২৩ নাবিক দেশে পৌঁছেছেন। এমভি আবদুল্লাহর এই ২৩ নাবিকের বিষয়ে উৎকণ্ঠায় ছিল সারা দেশের মানুষ। ২৩ নাবিকদের বহন করা লাইটার জাহাজ মঙ্গলবার (১৪ মে) যখন চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় তখন ছিল এক অভাবনীয় দৃশ্য। খুশিতে চোখের নোনা জল মুছেছেন নাবিকদের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানরা।
জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার সালাইনগর দক্ষিণপাড়া গ্রামের জিয়াউর রহমানের ছেলে ও জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক (ওএস) জয় মাহমুদ। বুধবার (১৫ মে) সকালে জানালেন নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
জয় মাহমুদ জানান, ‘জিম্মি করার পর দস্যুরা আমাদের ওপর অনেক অত্যাচার করত। যখন দেখেছে আমরা নিয়মিত নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি তখন তাদের মন নরম হয়। এরপর থেকে তারা নরম সুরে আমাদের সাথে কথা বলে এবং অত্যাচারের মাত্রা কমিয়ে দেয়। তবে কখনও ভাবিনি আমরা জীবিত বাড়ি ফিরে আসব।
তিনি বলেন, ‘দস্যুরা যখন আমাদের জিম্মি করে তখন আমরা ভাবিনি বেঁচে ফিরব। বন্দুকের নলের মুখে আমাদের থাকতে হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আতঙ্কের। প্রতিটি দিনই ছিল দীর্ঘ। বন্দিদশার ৩৩ দিনকে মনে হয়েছে ৩৩ বছর। প্রতিটি দিন কেটেছে আতঙ্ক ও কষ্টের মধ্যে। আমরা শুধু নামাজ পড়েছি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি।’
‘মনে হতো আর মায়ের কাছে ফেরা হবে না’
নাবিক জয় বলেন, তবে আস্তে আস্তে দস্যুরা যখন স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে তখন মনে একটু একটু করে সাহস পাই আমরা। ঈদের দিন ঈদ মনে হয়নি। ঈদে শুধু নামাজ পড়তে পেরেছিলাম। আর কিছু করতে পারিনি। এবার ঈদে আনন্দ ছিল না। এখন বাড়ি ফিরতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আপ্লুত জয়ের বাবা-মা। আর নাতিকে ফিরে পেয়ে স্বস্তি ফিরেছে তার বৃদ্ধ দাদির মনেও।
বাবা জিয়াউর রহমান বলেন, আমার ছেলে আজ সকালে বাড়ি ফিরেছে। আমরা খুব আনন্দিত। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী, দেশবাসী, জাহাজ কর্তৃপক্ষ, মিডিয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। মহান আল্লাহর কাছে শত কোটি শুকরিয়া জানাই।
মা আরিফা বেগম বলেন, আমার বুকের ধন বুকে ফিরে এসছে। এটাই বড় আনন্দ। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ যে আমার মানিককে আমার বুকে ফিরিয়ে দিয়েছে এজন্য তার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই। এবার ঈদে আমাদের কোনো আনন্দ ছিল না। আমার বুকের ধনের জীবিত ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন কেটেছে। সে জীবিত বাড়ি ফিরে আসায় আমাদের এখন ঈদের দিন মনে হচ্ছে।
জয়ের বৃদ্ধ দাদি বলেন, ‘আমার নাতি বাড়ি ফিরে আসিছে তাই মনে শান্তি পাচ্ছি। কত যে কান্দিচি তা বলে বুঝানো যাবেনা। আল্লাহ আমার নাতিকে দীর্ঘজীবন দান করুক। এটাই আমার চাওয়া।’
প্রসঙ্গত, ৩৩ দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত হয়। এরপর জাহাজটি প্রথমে আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পণ্য খালাস শেষে আরেকটি বন্দর থেকে চুনাপাথর বোঝাই করে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। এ হিসেবে আমিরাত থেকে ১৩ দিনের মাথায় জাহাজটি বাংলাদেশের জলসীমায় এসে পৌঁছালো।
কেএসআরএম গ্রুপ জানায়, এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৫৬ হাজার টন পণ্য চুনাপাথর রয়েছে। এতে প্রায় ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজটির ড্রাফট (জাহাজের পানির নিচের অংশের গভীরতার পরিমাপ) বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১২ মিটার। জাহাজটির ড্রাফট বেশি থাকায় কুতুবদিয়ায় প্রথমে কিছু পরিমাণ পণ্য খালাস করে। এরপর পতেঙ্গার কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে বন্দর জলসীমায় আনা হয়। সেখানে বাকি পণ্য খালাস করা হবে। এ জন্য দেশে পৌঁছানোর পরও নাবিকদের ঘরে ফিরতে একটু সময় লেগেছে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।
আপনার মতামত জানান