সাতজন বিদেশি প্রতারক গ্রেপ্তার

প্রকাশিত

নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সাত জন এসেছেন ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। উদ্দেশ্য প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। তাদের টার্গেট সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা। প্রতিমাসে এই সাত বিদেশি গড়ে ৩০-৩৫ প্রতারণার ঘটনা ঘটান। হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।

নাইজেরিয়ার নাগরিক উজেকি ওবিননারুবেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাতমবিখনা গেবুজা, নাইজেরিয়ার ইফুনানিয়া ভিভিয়ান নাওকি, সানডে সেদারেক ইজিম, চিনেদু মোসাস নাজি, কলিমস ইফেসিনাসি তালিকি ও সিদিম্মা ইবেলি ইলোফরকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। বুধবার (১২ জানুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন রাব। এছাড়াও তাদের সহযোগী দুই বাংলাদেশি হলেন, ফেনীর নাহিদুল ইসলাম ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার। অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে ৮টি পাসেপোর্ট, ৩১টি মোবাইল সেট, ৩টি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, তিনটি পেনড্রাইভ ও নগদ ৯৫ হাজার ৮১৫ টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির পর দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল বিছাতো তারা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে একজন নারী ভিকটিমকে ফোন দিয়ে বলতো একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে, এটি ডেলিভারি নিতে হবে, মোটা অংকের টাকা বিকাশে কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারে পরিশোধ করতে হবে। আর পার্সেলে যেহেতু অতি মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে, তাই কাস্টমস চার্জ একটু বেশি বলে ভিকটিমদের কাছে উপস্থাপন করা হয়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের এসব বিদেশি নাগরিকেরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। গার্মেন্টস ব্যাবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এমন অভিনব প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ ও গ্রেপ্তার দুজনের নামে আগেও মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের দেশীয় সহযোগী বলে জানান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক। তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে প্রতারণার কাজে সহায়তার জন্য ভিকটিমদের কাছ থেকে প্রতারিত টাকার ২৫ ভাগ এই দম্পতি পেতো। ২০২১ সালে ৩৫ জন তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

পরিচয় দিতেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী হিসেবে:

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, নাইজেরিয়ান নাগরিক ওডেজে ওবিন্না রিবেন (৪২) ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসেন। তার ভিসার মেয়াদ নেই। এর আগেও ২০২০ সালের র‍্যাব-৪ এর একটি মামলায় পাসপোর্ট জব্দ করা রয়েছে। তিনি নিজেকে সবার কাছে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী পরিচয় দিতো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণায় ছিল তার মূল পেশা। আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের মূল হোতা তিনি।

ফুটবল খেলোয়াড়:

গ্রেপ্তার এই চক্রের বিদেশি আরেক নাইজেরিয়ান কোলিমন্স ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আসলেও ২০২১ সালে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়। অপর একজন নিজেকে ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় দিতেন। নিজেকে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পরিচয় দিতেন গ্রেপ্তার প্রতিটি বিদেশি। বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতারণা।

প্রতারণার কৌশল:

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ভিকটিম নির্ধারণ করার পর তাদেরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ভিকটিমদের  সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেন। ভিকটিমদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠাতেন বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভিকটিমকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করা হতো।

নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ:

বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানান, তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। কিন্তু তারা তা খরচ কিংবা দেশে নিতে পারছেন না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চান এবং বলেন তাদের কাছে রেখে দিতে। পরবর্তীতে যেকোনো সময় নিয়ে নেবেন। চাকরিজীবীদের বলেন তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন এবং এতে তারা একটি নির্দষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদেরকে বলা হতো, তার ব্যবসায় অর্থলগ্নি করবেন ও তিনি ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমিশন পাবেন। যাতে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রভাবিত হন।

উপহার প্রদান:

ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায় ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম, ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলেন দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।

অর্থ সংগ্রহ:

পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের বাংলাদেশি নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলেন, তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস্ চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয়, তাই চার্জ কিছুটা বেশি দিতে হবে। এজন্য নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদেরকে মামলার ভয়ভীতি দেখানো হতো। এক পর্যায়ে সহজ সরল ভুক্তভোগীরা তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ব্যাংকিং অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছিল।

আপনার মতামত জানান