মহাবিজয়ের মহানায়ক

প্রকাশিত



১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমরা যাঁরা এই সময়কে প্রত্যক্ষ করেছি, তাঁদের কাছে সেই দিনের স্মৃতি অসাধারণ আবেগের এবং আনন্দের। বিকেলের আলো নম্র হয়ে এসেছে, এ রকম সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। রেসকোর্স ময়দানের সেই সময়টা বাংলার আকাশের রং বদলে দিয়েছিল।

হাজার বছরেরও বেশি সময়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সীমাহীন ত্যাগ আর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সেদিন অর্জিত হয়েছিল বাঙালির বিজয়। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর সেই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এই ছবিটা আজও বিজয়ের উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের ইতিহাসে। মুক্তিকামী প্রতিটি বাঙালির জন্য এটি ছিল শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত। আমরা সেদিন রক্তস্নাত একটি বিজয়ের পতাকা বাংলার আকাশে ওড়াতে সক্ষম হয়েছি। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে মুখরিত ছিল রাজধানী, গ্রামগঞ্জ—সর্বত্র। এই যে মহাবিজয়, এ বিজয়ের মহানায়ক একজন। তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া বিচারের নামে প্রহসন করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন সময়গুলোতে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য অনিশ্চিত, তখন অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর বিখ্যাত—‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় মুজিবুর রহমান’ কবিতাটি রচনা করেন। সেটি তিনি রচনা করেছিলেন ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে। তারও আগে একাত্তরের ৭ই মার্চের সেই অগ্নিগর্ভ ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে ১৬ মার্চ কবি জসীমউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করেছিলেন ভিসুভিয়াসের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের হুংকারে আমরা দেখি তাঁর সেই অমর ভাষণের প্রতিধ্বনি। এপ্রিল মাসে ‘নিউজ উইক’ পত্রিকা তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল ‘রাজনীতির কবি’ নামে। বস্তুত পদ্মা-যমুনার জলস্রোত এবং ভিসুভিয়াসের অগ্নি উদগিরণ আরেকটি জাতির স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করার এই বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। সে কারণেই বাঙালির ইতিহাসে বহু বিখ্যাত নেতার উপস্থিতি সত্ত্বেও শেখ মুজিব ছিলেন আলাদা ও স্বতন্ত্র। তিনি সত্যিকার অর্থেই বাঙালির চিরকালের প্রতীক মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো খুব সহজ ছিল না। একটি প্রশিক্ষিত শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার আহ্বানে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের অনেক উদাহরণ আছে, যাঁরা ঔপনিবেশকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন—এই উপমহাদেশেও আমরা এ রকম উদাহরণ দেখি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সম্ভবত এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। তিনি বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদেরই একজন হিসেবে। কিন্তু এই নেতৃত্ব শুধু জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ লড়াইয়ে একদিকে ছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, অন্যদিকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। আর এই দুই মিলে লড়াইটা পরিণত হয়েছিল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানবিক এক লড়াই।

মুক্তির যে অন্বেষা বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন লালন করেছেন তার মূলে ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অদম্য এক ইচ্ছা এবং স্বপ্ন। তাঁর জীবনচর্চা, রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বক্তৃতায় সেই স্বপ্ন উঠে এসেছে বারবার। ৭ই মার্চের ভাষণে যখন তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন তখন তাঁর নির্দেশনার মধ্যেও ছিল ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়’। এভাবে তাঁর স্বপ্ন ও সংগ্রাম ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধু সুযোগ্য সহযোগী জাতীয় চার নেতা এবং অন্যান্যরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন ও চেতনাকে ধারণ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরিচালনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ। তাঁদের হৃদয়ে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি অবিমিশ্র আনন্দের ছিল না। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে স্বজন হারানোর শোক। দুই মিলেমিশে আনন্দ ও বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। সাধারণ মানুষের মনে হয়েছে এই বিজয় যেন অপূর্ণ। মুক্তির মহানায়ক ফিরে আসেননি তখনো। তারা অপেক্ষা করেছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে। অনেকটা ট্রয়ের যুদ্ধের পরে ইথাকার রাজা অডিসিয়াসের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতো। হোমারের ওডিসি মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র অডিসিয়াস বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ফিরে এসেছিলেন তাঁর দেশে। বঙ্গবন্ধুও ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর প্রিয় স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল স্বাধীনতা, সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের বিজয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা এবং সাধারণ মানুষ যেভাবে আনন্দ করেছেন সেটি অবিস্মরণীয়। এই প্রত্যাবর্তন ওডিসির মহাকাব্যিক ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

এখন আমরা পালন করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এ বছর বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকী চলছে। করোনা পরিস্থিতিতে জন্মশতবার্ষিকীর অনেক কাজ সমাপ্ত হয়নি বিধায় মুজিববর্ষের মেয়াদও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। যে জাতিকে দীর্ঘ অত্যাচার-নিপীড়নের নাগপাশ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, এনে দিয়েছেন আরাধ্য বিজয়, সে বিজয়েরও সুবর্ণ জয়ন্তী। আজ এ যেন বাঙালির গৌরবের এক মিলিত মোহনা। একই সঙ্গে মুজিববর্ষ এবং সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত গৌরবের, যার অংশীদার আমরা সবাই।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন। সে সময়ের প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের যাঁরা প্রত্যক্ষ সাক্ষী, তাঁদের স্মৃতিকথা থেকে আমরা জানতে পারি তিনি কিভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর যাত্রা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পদে পদে প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি দমে যাননি। বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। ঘাতকের বুলেটে তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে গেছে।

আজ বিজয়ের ৫০ বছরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকালে আরেকটি কঠিন ও দীর্ঘ লড়াইয়ের চিত্র আমাদের চোখে ভাসে। সেটি করেছেন তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার—এ রকম কঠিন কাজ সম্পাদনের পাশাপাশি সোনার বাংলা গড়ার যাত্রাকে তিনি আলাদা মাত্রা দিয়েছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত—উন্নয়নের এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য শেখ হাসিনার হাতে আলাদা গতি পেয়েছে। এখন আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ এখন তথ্য-প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অর্জন অনেক—শতভাগ বিদ্যুৎ, শিক্ষা, সমুদ্র বিজয়, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাস, নারী ক্ষমতায়ন, বিশ্বসভায় পরিবেশ দূষণবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন মানবহিতকর কাজ মিলে এই ৫০ বছরে বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান এখন অনেক সুদৃঢ়। দীর্ঘ যাত্রার এই সময়ে বাঙালির মহাবিজয়কে উদযাপন ও মহানায়কের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা সুযোগ এসে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে একদিন যাঁরা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সারা পৃথিবী, সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিও শ্রদ্ধা জানানোর এটি প্রকৃষ্ট সময়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রয়াত হয়েছেন। তিনি একদিন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বলেছিলেন, ‘বুলেট শরীরকে ধ্বংস করতে পারে, আত্মাকে নয়।’ বঙ্গবন্ধু আজ শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে উপস্থিত নেই, কিন্তু তাঁর সংগ্রাম-আন্দোলন এবং ত্যাগের আলোকশিখা এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে। এই আলো প্রতিদিন উজ্জ্বলতর হচ্ছে। বিজয়ের এই ৫০ বছরে আমরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে যেমন উদযাপন করব বিজয়ের আনন্দ এবং আবেগ, সেই সঙ্গে মহাবিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিও জানাবো আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

লেখক : কামাল চৌধুরী
প্রধান সমন্বয়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি

আপনার মতামত জানান