হুমায়ূন আহমেদ সময়ের অমীমাংসিত বরপুত্র
হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এখন যে মূল্যায়ণ চলছে, তা সবই একদেশদর্শী। অনেকটা করার অর্থে করা। পৃষ্ঠা ভরার তাগিদ থেকে যা খুশি তাই লিখে যাওয়া। শতাব্দী পার না হলে কোনো লেখক সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ণ করা যায় না। আমরা হুমায়ন আহমেদ থেকে খুবই অল্প দূরত্বে আছি। পুরো অবয়বটি দৃষ্টিসীমায় আসতে আরো অনেক সময় প্রয়োজন। এখন যা করা যায় তাহলো প্রশংসা নয়তো সমালোচনা। এর বাইরে আরেকটি নিরাপদ পথ রয়েছে, ধারা বিবরণী দেয়া। অমুকের সন্তান এত তারিখে জন্ম নিয়ে অমুক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করলেন, অমুককে বিয়ে করলেন, ছেড়ে দিলেন, তারপর তমুককে বিয়ে করলেন, এতগুলো সন্তান আছে তার, এই এই বই লিখেছেন, এই এই নাটক-সিনেমা বানিয়েছেন এবং সেদিন বৃষ্টিমুখর দিনে মৃত্যুবরণ করেন ইত্যাদি নির্মোহ ধারা বিবরণী।
হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে, নাটক দেখে, সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার অনেকে তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিভিন্ন রকম ভুলভাল বিশেষণও দিয়েছে তাকে। তার সবচেয়ে বড় সমালোচনাটি হচ্ছে রাজনৈতিক। একটি সমাজ-রাষ্ট্রের জীবন যাপন সম্পর্কিত সকল প্রকার অনুভূতি রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। লেখক প্রধানত অনুভূতির জায়গাতে কাজ করেন। নানা রকম অনুভূতি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় লেখক রাজনৈতিক প্রভাবটি টের পাবেন না, এটা হতেই পারে না। হুমায়ূন আহমেদও টের পেয়েছেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সুকৌশলে চেপে গেছেন নিজের মতামত কিংবা প্রতিক্রিয়া। তবে নির্বিশেষে চেপে গেছেন তা বলা যাবে না। কারন তার একটি নাটকে দেখা যায়, একজন অতিমাত্রার বিলাসী মন্ত্রীর রগচটা পিএসকে এক পাগল এসে থাপ্পড় মেরে দাত ফেলে দিচ্ছে। সেই দাত ফেলা নিয়ে বাউল গানের আসরে জনৈক বাউল রসালো গান গেয়ে শোনাচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রকে ভীষণ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে খেলো করে তোলেন। এটা বিমূর্ত প্রতিক্রিয়া। এজন্য লেখককে কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না।
এই দায়িত্ব নিতে না চাওয়ার একটি ধারাবাহিক প্রবণতা আমৃত্যু বজায় থেকেছে হুমায়ূন আহমেদের ভিতর। শুধু ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটার পুনরোচ্চারণই যেন তার জীবন। হিমু চরিত্র তার অমর সৃষ্টি। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক, যেকোনোভাবেই চরিত্রটি অমর। হিমুকে অনুকরণ করা যুবকদের পক্ষে ভালো না খারাপ, সেই প্রশ্নে না গিয়ে এটুকু বলা যথেষ্ট হবে যে, একটা সময়কাল ধরে সমাজে কর্মোদ্যোমী তরুণদের কেমন নির্বিকার স্বরূপ নির্মিত হয়েছিলো, হিমু তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে। ব্যক্তিবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা প্রায় শৈল্পিক স্তরে উত্তীর্ণ হওয়ার নির্মম সাক্ষী এই চরিত্রটি। একইসাথে নাসির আলী সবকিছুকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায়, এটাও সমকালীন আর্তধ্বনির বিশেষ প্রকাশ। কারন একই। সমস্ত প্রকার অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য, বঞ্চনা, নৈরাশ্য থেকে প্রশ্ন করার যে বিলাসী প্রবণতার জন্ম হয়, সেটি এক ধরনের বাস্তবতাই।
হাসির কান্ড, সহজ বাক্য, গল্পের বৈচিত্র, স্থূল পরিহাস, টান টান ঘটনাক্রম সবই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সফলতা দেয়। এজন্য অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। ঈর্ষার চেয়ে উদ্বেগের গুরত্ব বেশি। সমাজের দিকে তাকিয়ে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দেখে যারা উদ্বিগ্ন হয়, তাদের কাছে এসব বৃথা শক্তির অপচয় মাত্র মনে হয়। তবে কে ঈর্ষান্বিত আর কে উদ্বিগ্ন তার সুনির্দিষ্ট কোনো বাটখারা নেই আপাতত। তাই হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে নির্জলা মন্তব্য করার বিপদও অনেক। দেখো, উনি অমন জনপ্রিয় হতে না পেরে হুমায়ন আহমেদ সম্পর্কে আবোলতাবোল বলছেন, উনি এই অধঃপতন মানতে পারছেন না বলে হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রতিভার অপচয় দেখে যন্ত্রণা পাচ্ছেন, উনি যদি নিজে পারতেন সমস্ত সংকট দূর করতে, তাহলে আর হুমায়ন আহমেদের প্রতিভার সুব্যবহার প্রত্যাশা করতেন না। এসব মন্তব্যের কোনটা ঠিক কোন সমালোচকের জন্য প্রযোজ্য, তাই নিয়ে এখন বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। এখানেও রয়েছে রাজনৈতিক সংকটজনিত কার্যকারন।
হুমায়ূন আহমেদ সকল প্রকার রাজনৈতিক সংকটকে পাশ কাটিয়ে একটি নতুন মাত্রায় ভাষা দক্ষতার বিস্তার ঘটিয়েছেন। এটাকে হয়তো কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যাবার সাথে তুলনা করা যায়। একটুর জন্য লাগেনি, সামান্য ছুঁয়ে গেলেই মাথা ঝাঁঝরা হয়ে যেতো। আজীবন মাথা বাঁচিয়ে ধারাবাহিক জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে পার হবার কারনে হুমায়ূন আহমেদ ইতিমধ্যেই এক ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে। এমন লেখক সময়ের সৃষ্টি নাকি সময়ই নতুন করে সৃষ্টি লাভ করেছে লেখকের হাতে, ডিসকোর্সটা এই নিরিখে। তবে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির স্ক্রিপ্ট অপরিবর্তিত রাখার দৃঢ়তা দেখিয়ে তিনি আরেকটি ডিসকোর্সের জন্ম দিয়েছেন। টিভির নাটকের ঘটনা পাল্টাতে বাস্তবের মানুষ মিছিল করছে! ঢাকার শাহবাগে প্রতিবাদী জনতা নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছে! সস্তা জনপ্রিয়তার কাঙাল হলে এমন ক্ষেত্রে স্ক্রিপ্টে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা অনেকটা স্বাভাবিক।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দিতে অনড় থাকার পেছনে দুটো কারন থাকতে পারে। এক, দর্শকদের চাপে স্ক্রিপ্ট পাল্টানো লেখকের অদূরদর্শিতাকে প্রকট করে তোলে, যা লেখা হয়েছে তাই থাকবে, কোনো পরিবর্তন হবে না, হুমায়ূন আহমেদ হয়তো এটা ভেবেছিলেন। দুই, বাকের ভাই একটি কাল্পনিক চরিত্র, এটা বাস্তবে নেই, সম্ভবও না, তাই মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই, মানুষকে বাস্তববাদী করে তুলতে চাইলে বাকের ভাইকে ফাঁসি দিয়ে অদৃশ্য করে দিতে হবে, এই বাংলায় মানুষ খুব পরনির্ভরশীল হতে পছন্দ করে, প্রতিবাদ সবাইকে করতে হয়, একজন প্রতিবাদ করবে বাকিরা তাকিয়ে দেখবে এটা শেখানো লেখকের কাজ না, লেখকের কাজ মানুষকে জাগরিত করা, এই জাগানোর জন্যই হয়তো তিনি স্ক্রিপ্ট অপরিবর্তিত রাখার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। নিষিদ্ধ সময়ে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে রাজাকার বলানোর অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করার মতো লেখক দ্বিতীয় বিষয়টি ভেবেছেন বলে আমরা প্রত্যয় করতে পারি। তবে পরবর্তী জীবনে তার হেয়ালির নমুনা দেখে সেখানেও ধাক্কা না লেগে উপায় থাকে না। ফলে এটি একটি অমিমাংসিত তর্ক হয়েই থাকছে।
মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত হুমায়ন আহমেদের সিনেমাগুলো বিশেষ স্বাতন্ত্র বহন করে। এই তীব্র দহনকালের গল্পতেও তিনি দর্শককে হাসাতে চেয়েছেন। যদিও চেষ্টাটি মাত্রা ছাড়ায়নি কখনো। তবে যুদ্ধের সিনেমার গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে নির্মাণ পরিকল্পনার পেছনে বাজারের হিসেবটা বরাবর বজায় থেকেছে। তার গল্পে মুক্তিযুদ্ধকে ছাপিয়ে ভিন্নতর কিছু প্রধান হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে তিনি কেবল গল্প বুনেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি বাগাড়ম্বর করেননি। এখানেও তার বিতর্ক এড়িয়ে মাথা বাঁচানোর মনোভাবটি কাজ করেছে বলে খুব সহজেই মনে হতে পারে। আবার শিল্পের উচ্চমার্গীয় আঙ্গিক নিয়ে কাজ করেছেন বললেও অত্যূক্তি হবে না। ফলে তর্কটি ভবিষ্যতের জন্যই তুলে রাখা ভালো।
‘নন্দিত নরকে’র হুমায়ূন আহমেদ, রসায়ন শাস্ত্রে পিএইচডি করা প্রথিতযশা অধ্যাপক, প্রিন্সিপল ইব্রাহিম খাঁর মেয়েজামাই, শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধার জ্যেষ্ঠপুত্র, পাকবাহিনীর হাতে আটক হয়ে গুলির নিশানা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া জনৈক, তদুপরি সাজানো-গোছানো সংসারের কর্তা হুমায়ন আহমেদ ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকলেন আত্মরতির বিবরে। হারাতে হারাতে তিনি অপরের কাছে হয়ে উঠলেন অতি মাত্রায় দৃশ্যমান। এ যেন নিজের কাছ থেকে নিজেকেই হারিয়ে ফেলা। এই হারিয়ে ফেলার মধ্যে নিজের দায় যেমন আছে, তেমন আছে সমকালেরও দায়। সমকাল যখন সব কিছুকে নিয়ে ছেলেখেলা করে, তখন একজন হুমায়ূন আহমেদ অধিকতর ছেলেখেলায় মেতে ওঠার বৈধতা পেয়ে যায়। তবে এই বৈধতার প্রশ্নটি নিরঙ্কুশ নয়। শুধু সময়ের হাতে নিজেকে সঁপে দিলেই ব্যক্তি তার দায় এড়াতে পারে না। বরং ব্যক্তিরও রয়েছে সময়ের প্রতি বিশেষ কিছু দায়িত্ব। হুমায়ূন আহমেদ দানবীয় প্রতিভা হয়েও সময়ের প্রতি নিজ দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে পালন করেননি বলেই আমাদের প্রতীতি জন্মায়। আবার এও তো সত্য যে, শিল্পীর জীবনটাই ভিন্নতর এক শিল্পোপকরণ। ভবিষ্যতে কাটাছেড়া হবে জেনেই হয়তো সমৃদ্ধ এক জীবনকে যাপন করে গেছেন তিনি। আমরা কেবল এটুকুই বলতে পারি যে, অমীমাংসিত সময়ের অমীমাংসিত প্রতিভার নাম হুমায়ূন আহমেদ।
# মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন
লেখক-কবি-প্রাবন্ধিক
সুত্র: কালের কন্ঠ
আপনার মতামত জানান