সৌন্দর্যের ঢালি নিয়ে শীতেই ফুটছে বাসন্তী ফুল পলাশ

প্রকাশিত




“পলাশ ফুলের মউ পিয়ে ওই/বউ- কথা- কও উঠল ডেকে/ শিস দিয়ে যায় উদাস হাওয়া/ নেবু ফুলের আতর মেখে।।”-কাজী নজরুল ইসলাম
বসন্তকে রঙীন ফুলে বরণ করে নিতে বৃক্ষরাজি পুরনো পত্রপল্লভ ফেলে মায়াবী কচি সবুজ পাতায় যখন নতুনকে ডাকছে তখন প্রকৃতির যেন আর তর সইছে না। মাঘের শেষ প্রান্তিকেই প্রকৃতি হাসছে নববধুর সাঁজে, খোপায় পড়েছে রক্ত রাঙা পলাশ। এ যেন শুষ্ক রুক্ষ শীতের আড়মোড়া ভেঙ্গে নিয়ম ভেঙেই বসন্তের আগমনী বার্তা। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের লোকজ মেলার আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে গ্রামবাংলার অতি পরিচিত রক্ত রঙা পলাশ শিমুলের কচি পাপড়িতে কাঠ শালিকের ছোটাছুটি। তবে নিস্বর্গবিদরা বলছেন, আবহাওয়ার হেরফেরে এ বছর ফাগুন আসার আগেই বসন্তের ফুল।

শীতের অলস সকালে ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষ যখন কম্বল মোড়া, ঠিক তখন শান্ত রোদ গায়ে মেখে প্রকৃতি রাঙ্গাচ্ছে রুদ্র পলাশ। জানুয়ারির শেষ থেকেই রূপের সবটুকু সৌন্দর্য মেখে নিজেকে মেলে ধরেছে পলাশ।
একেবেঁকে চলা সবুজ শ্যামল গ্রামের প্রতিটি কোনায় কোনায় রঙীন ফুলের ঢালি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ, শিমুল প্রশান্তির দোলা দেয় প্রকৃতির এই নৈবেদ্য।

আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানো জ্বালা। এটা শুধু কবিতা নয়, এ যে স্বাধীনতাযুদ্ধে রক্তাক্ত ভাইয়ের চেতনা। লাখো ভাইয়ের রক্তে রাঙা পলাশ ফুল প্রাণস্পর্শী সুরে মূর্ত হয়ে উঠেছে। কবির শব্দাবলীতে বাংলার নানা বর্ণিল ফুলের সঙ্গে পলাশ ফুলেরও মুগ্ধতার বর্ণনা আছে।

ফাগুনের আগমনী সুনন্দ শোভন এক ফুল পলাশ। এখন প্রকৃতির মুগ্ধতা ছড়ানো ফাগুন রাঙা পলাশ ফোঁটার মৌসুম। লাল কমলার মিশেলে সবুজ প্রকৃতির মাঝে অপরূপ শোভন এ ফুল। গাছটি যেমন শোভা বর্ধন করে, তেমনি ঔষধি গুণেও সমৃদ্ধ। আবার হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিদ্যা দেবী সরস্বতী পূজা অর্চনায় পলাশ ভীষণ দরকারি। পলাশের পরিকল্পিত কোনো আবাদ সম্প্রসারণ হয় না। তবে শখ করে কেউ দুই একটি গাছ লাগিয়ে থাকেন।


পলাশ মূলত পাতাঝরা মাঝারি আকারের বৃক্ষ। সাধারণত ১২-১৩ মিটার পর্যন্ত উচ্চতা নিয়ে বেড়ে চারদিকে শাখা প্রশাখা ছড়ায়। আঁকা-বাঁকা শাখা-প্রশাখা বেশ মসৃণ। ফাল্গুন আসতেই পাতা ঝরে কালচে খয়রি রঙের মুকুল বের হয়ে ফুল ফোঁটে। তখন ডালভর্তি লাল কমলার মিশেলে ফোঁটা পলাশ দূর থেকে আগুন ছড়ায় দৃষ্টিতে।

পলাশ গাছ তার নয়নাভিরাম ফুলের জন্যই জনপ্রিয়। এর ইংরেজি নাম প্যারোট ট্রি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Butea monosperma। বৃক্ষটি Fabaceaeপরিবার ভূক্ত। গাঢ় সবুজ ত্রিপত্রী বিশিষ্ট। শীতে ঝড়ে যায় পাতা। বসন্ত এলে হলুদ,কমলা আর লাল রঙের মিশেলে পলাশ ফোঁটে।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক এসএম রেজাউল বলেন, ফাউন্ডেশনের লেকের পাড়ধরে অনেকগুলো পলাশ ও শিমুলের গাছ আছ। প্রতিবছর পলাশ ফুটলেই বেশ শোভন লাগে। যেহেতু জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে লোকজ মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেহেতু অনেক প্রকৃতি প্রেমিরা পলাশ, শিমুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় অনায়াসে।

সোনারগাঁ জি, আর ইনিস্টিটিউশনের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এমএ সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, পলাশ আমাদের দেশজ এক তরু হলেও এর কোনো পরিকল্পিত আবাদ নেই। পলাশ ফুল শুধু প্রকৃতির শোভা বর্ধণ করে না এটি নানা রোগে ঔষধি বৃক্ষ হিসেবে কাজ করে। তবে ফলে ফুলটি আগের মতো আর দেখা মেলে না। পরিবেশ বান্ধব পলাশ বৃক্ষসহ আমাদের দেশজ তরু টিকিয়ে রাখা জরুরি। দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে পলাশ গাছ রোপণ অভিযান শুরু করা যেতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ পলাশ ফুলকে ভালবেসে লিখেছেন, “রাঙ্গা হাসি রাশি-রাশি অশোকে পলাশে/ রাঙ্গা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে/ নবীন পাতায় লাগে রাঙ্গা হিল্লোল।”

আপনার মতামত জানান