লোকজ মেলায় লোকঐতিহ্যের রূপ
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চর্চা আর ধ্যান-জ্ঞানে ছিল লোকজ সংস্কৃতি। লোকশিল্পের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থাকায় বাঙালির মৌলিক চর্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সোনারগাঁয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন কতৃপক্ষ লোকজ শিল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রতি বছর আয়োজন করেন লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব।
প্রতিবছরের মতো এবারও ১৮ জানুয়ারি সোনারগাঁয়ে শুরু হয়েছে লোকজ মেলা। মাসব্যাপী এই আয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকশিল্পীরা অংশ নিয়েছেন। তাঁদের ৩২টি স্টল ঐতিহ্যবাহী একেকটি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে কর্মরত শিল্পীরা। স্টলে স্টলে স্থান পেয়েছে মৃৎ, কাঁসা-পিতল, শঙ্খ, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, শোলাসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা শিল্পের নিদর্শন। ময়ূরপঙ্খি স্টেজে চলছে জারি-সারি, পুঁথি পাঠসহ লোকগীতি পরিবেশনা।
একটি স্টলে রয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি। স্টলের স্বত্বাধিকারী সুশান্ত কুমার পাল জানান, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ৩৫টি সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে স্টলে বসেই শখের হাঁড়ি অলঙ্করণ করছিলেন। তাঁদের একজন সঞ্জয় বলেন, ‘দুই ভাই বাবার কাছ থেকেই কাজ শিখেছি। মাটির সাথে শিল্পের এ সখ্যতা আমাদের খুব ভালো লাগে।’ অন্য একটি স্টল এক কাঠের ঘোড়া ও পুতুল তৈরি করছেন আশুতোষ সুত্রধর। এক কাঠের ঘোড়া শিল্পের শেষ প্রজন্ম এই আশুতোষ সুত্রধর ও বীরেন্দ্র সুত্রধর। তারা সোনারগাঁয়ের স্থানীয় কারুশিল্পী। বাংলাদেশে এ দুজনই এক কাঠের ঘোড়া ও পুতুল তৈরি করছেন। তাদের সন্তানেরা এ শিল্পে অনাগ্রহ দেখিয়ে অন্য কাজ করছেন। তাদের পর এ দেশে আর এক ঘোড়া ও পুতুল তৈরির শিল্পী থাকবেনা বলে জানিয়েছেন তারা। আশুতোষ সুত্রধর বলেন, জাপান, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড সহ কয়েকটি দেশেই তিনি কর্মরত কারুশিল্পী কাজ করেছেন। পেয়েছেন অনেক সম্মাননা পুরস্কার। কিন্তু ঐতিহ্যের টানে এ শিল্প ধরে রেখে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটানোয় তার সন্তানেরা অন্য কাজে চলে গেছেন। পাশের স্টলেই ঢাকার রায়েরবাগের বিপদ ধরি পালের। তিনি চ্যানেল আই পুরস্কারপ্রাপ্ত শখের হাঁড়ির শিল্পী।
মেলায় সুচি শিল্পের নকশিকাঁথা নিয়ে এসেছেন সোনারগাঁয়ের হোসনেয়ারা বেগম। তাঁর সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড় যেন কথা বলে। সুই সুতোয় সৌখিনতার গল্প বুনে চললে মেশিনের রঙীন প্রিন্টের কাছে বার বার নতি স্বীকার করতে হয় বলে জানান হোসনে আরা। আধুনিক নকশায় প্রাচীন সেলাইয়ের নতুন ফম তুলে আনা এ সুচিশিল্পী আরো বলেন, ‘আমি সুঁই-সুতা দিয়ে আমার স্বপ্ন বুনে যেতে চাই আজীবন কিন্তু মানুষ এখন শিল্প বা সৌখিনতা খুজে না তারা বাহারী প্রিন্টের সস্তাদামী জিনিস খুঁজে।’
নিখুঁত অবয়ব না হলেও নরম মাটি টিপে আদি ও অকৃত্রিম ফিগার গড়ছেন কিশোরগঞ্জের সৈয়ালপাড়া গ্রামের আরতি রানী। মা রেণু রানী পালের কাছে শেখা এ শিল্পের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে নতুন প্রজন্ম।
সুন্দর, নিখুত ও আধুনিক গড়নায় তৈজসপত্র তৈরি করে সম্মাননা পেয়েছেন দারুশিল্পী হাজি আউয়াল সাহেব। শিল্পী পরেশ চন্দ্র বেত দিয়ে তৈরি করেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ ময়ূরপঙ্খি নৌকা, ট্রাক, মোড়া ও নানারকম খেলনা। তারা দুজনেই সোনারগাঁয়ের শিল্পী। এ শিল্প ধরে রাখতে তাদের সন্তানকেও উদ্বুদ্ধ করছেন এ শিল্পে।
বরিশালের শংকর মালাকারের ছেলে নিখিল মালাকার শোলার ফুল ও টোপর তৈরি করেন। তাঁর পরিবারের সবাই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ধাতব শিল্পের চমৎকার একটি স্টল রয়েছে মেলায়। বাকুরার ঘোড়া, মিসরের মূর্তি, হিন্দু মিথলজির নানা চরিত্র গড়েছেন তামা-পিতল-কাঁসা শিল্পী মানিক সরকার।
নানা নকশার শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন হরেন্দ্র কুমার দাস।
মৌলভীবাজারের ধূলিজুরা গ্রামের এই বেতশিল্পী জানান, ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি এখন তারা সমকালীন চাহিদার কথাও মাথায় রাখছেন। এ কারণে টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট ইত্যাদিও তৈরি করছেন।
মেলা প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিচালক এসএম রেজাউল করিম বলেন, আমাদের সমৃদ্ধ অতীত, হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও শিল্পের কাছে গিয়ে নতুন প্রজন্মকে ঋদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই লোকজ মেলার আয়োজন। মেলা চলবে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
আপনার মতামত জানান