মা-মেয়ের ওপর বর্বরতা, নিন্দার ঝড়

প্রকাশিত



কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাংয়ে গরু চুরির অভিযোগে মা-মেয়েকে কোমরে রশি বেঁধে নির্যাতন ও প্রকাশ্যে ঘোরানোর একটি ছবি গত শনিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এই নিষ্ঠুর বর্বরতায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ঘৃণ্য এ কাজের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবি উঠেছে। গত শুক্রবার দুপুরে ঘটনাটি ঘটে হারবাং ইউনিয়নের পহরচাঁদা এলাকায়।

দ্রুততম সময়ে এ ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে গতকাল রবিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) শ্রাবন্তী রায়কে। অন্য দুই সদস্য হলেন চকরিয়ার এসি ল্যান্ড মো. তানভীর হোসেন ও উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সনজয় চক্রবর্তী।

এদিকে সাত দিনের মধ্যে এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে চকরিয়া সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার কাজী মো. মতিউল ইসলামকে নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক রাজীব কুমার দেব। গতকাল এই নির্দেশ পাওয়ার পর সরেজমিন তদন্ত শুরু করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা। তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেন।

ঘটনার সময় বর্বরতার শিকার একই পরিবারের চার সদস্যসহ (তিনজন নারী) পাঁচজনকে পিটিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পাঁচজনকেই নিয়ে যাওয়া হয় চকরিয়া থানায়। এরপর তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয় হারবাং ইউনিয়নের বৃন্দাবনখিল গ্রামের মাহবুবুল হকের করা মামলায়।

বর্তমানে এই পাঁচজন জেলহাজতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন চকরিয়া থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, গরু চুরির ঘটনায় থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচজনকে শনিবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

মা ও মেয়ের প্রতি এই বর্বর ঘটনার পর স্থানীয় হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মিরানুল ইসলামকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। গরু চুরির অভিযোগ থাকলেও ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুলের ইন্ধনে অতিউৎসাহী কিছু দুর্বৃত্ত এমন বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে।

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
গত শুক্রবার দুপুরে একটি গরুর বাছুর চুরি করে অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা ধাওয়া দিয়ে অটোটি আটক করে। এ সময় অটোতে থাকা তিন নারী ও দুই পুরুষকে পিটিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে মা পারভীন ও মেয়ে সেলিনা আক্তার সেলিকে প্রকাশ্যে সড়কে হাঁটানো হয়। এর ভিডিও শনিবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এলাকাবাসী জানায়, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরানুলের মাধ্যমে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা ব্যক্তিরা হলেন- কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ছুট্টু (২৭), চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের শান্তিরহাট এলাকার শহীদের কলোনির মৃত আবুল কালামের স্ত্রী পারভীন আক্তার (৪০), ছেলে মো. এমরান (২১), মেয়ে সেলিনা আক্তার সেলি (২৮) ও রোজিনা আক্তার (২৩)। অটোরিকশাচালক পালিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গরু চুরির অভিযোগে তিন নারীসহ পাঁচজনকে আটক করে পিটিয়ে এবং দুই নারীকে কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্যে ঘোরানোর খবর পেয়ে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম গ্রাম্য চৌকিদার পাঠিয়ে তাঁদের ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসেন। এরপর বিকেল ৫টার দিকে হারবাং ফাঁড়ির পুলিশের কাছে তাঁদের সোপর্দ করা হয়।

অনেকের অভিযোগ, ওই পাঁচজনকে ইউনিয়ন পরিষদে আনার পর চেয়ারম্যান মিরানুল নিজেও তাঁদের পিটিয়েছেন। ফলে তাঁরা গুরুতর আহত হন। তবে পেটানোর ঘটনা সঠিক নয় বলে দাবি করেন চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম।

হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পারসিত চাকমা বলেন, খবর পেয়ে তিন নারী ও দুই পুরুষকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

শনিবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ফুটেজে দেখা যায়, দুই নারীকে কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্যে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় এনামুল হক নামের এক গ্রাম্য চৌকিদার এক নারীকে বারবার স্পর্শ করছেন।

চকরিয়া থানার ওসি মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গরু চুরির ঘটনায় আইন হাতে তুলে নিয়ে এভাবে রশি দিয়ে বেঁধে দুই নারীকে প্রকাশ্যে ঘোরানো অবশ্যই অপরাধ। অতি=উৎসাহী কারা এমন ঘটনা ঘটাল, তাদের শনাক্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় চেয়ারম্যানের ইন্ধন থাকলে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।’

গতকাল রবিবার বিকেলে সরেজমিন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের ১ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে মা-মেয়ের ঠিকানা নিশ্চিত হতে পারেননি। তাঁদের যে ঠিকানা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে সে ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে এমন কারো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

চকরিয়া থানায় দায়ের করা মামলায় উল্লিখিত ঠিকানা অনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- কুসুমপুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল কালামের স্ত্রী শারমিন আক্তার (৫৫) ও মেয়ে সেলিনা আক্তার (২৮), রোজিনা আক্তার (২৫), ছেলে আরমান (২৫)।

মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উদ্বেগ
চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কর্তৃক মা ও মেয়েকে চুরির অভিযোগে রশিতে বেঁধে পেটানো এবং প্রকাশ্যে এলাকায় ঘোরানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। গতকাল রবিবার পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে এ উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানানো হয়।

সুত্র: কালের কন্ঠ

আপনার মতামত জানান