মানুষ কিভাবে চিন্তা করতে শিখেছে?

প্রকাশিত

তৌহিদ এলাহী

পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অনবদ্য বিষ্ময়। একেবারে স্বাধীন ও আলাদাভাবে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে প্রায় সমসাময়িক সময়ে মানুষের লিখিত দর্শনগুলো লিপিবদ্ধ হয়। একেকটির উৎপত্তির সাথে আরেকটির কোন স্বম্পর্কই ছিল না। আজ হতে প্রায় ২৭শত বছর পূর্বে ভারতীয় দর্শনের ভিত্তিমূল উপনিষদগুলো রচিত হয় অজানা লেখকদের হাতে। প্রায় সাড়ে পচিশশত বছর পূর্বে চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস তার দর্শন প্রচার করে গেছেন। সক্রেটিসদেরও আগে থেলিসের হাত ধরে গ্রিক তথা পাশ্চাত্য দর্শন শুরু হয় প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে। কাছাকাছি প্রায় ২৪০০/২৫০০ বছর আগে সিদ্ধার্ত গৌতমা নেপালের লুম্বিনি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন নির্বাণ লাভের দীক্ষা দিতে। এই দর্শনগুলোই পরবর্তীতে ছডিয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সারাদুনিয়ায়। মানুষ চিন্তা করতে শিখেছে তাদের দীক্ষায়।

মনে কি প্রশ্ন জাগে? ভারতীয়দের নীতিনৈতিকতা, জীবনাচরণ, আর্থিক অবস্থা কেন পাশ্চাত্যদের মত নয়? চীন, কোরিয়া,তাইওয়ান, জাপানসহ পূর্ব এশিয়ার মানুষগুলোর সামাজিক ও আর্থিক চরিত্রগুলো এমন কেন? ভারতীয় ও চাইনিজদের অধিকতর আর্থিক ও সামাজিক শক্তি থাকার পরেও পশ্চিমারা কেন এনলাইটনমেন্টের উপর ভর করে শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে গিয়ে সারা দুনিয়ার জ্ঞান ও আর্থিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে? ৮০০-১৩০০ সাল পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্য জ্ঞান বিজ্ঞান্ অর্থনীতিতে অসামান্য প্রভাব অর্জন করেও কেন পরবর্তীকালে মুখ থুবড়ে পড়ে? রাশিয়ানদের আসলেই নিজস্ব কোন দর্শন আছে কিনা? বামপন্থা এত হাইপ তৈরি করেও কেন মুখ থুবড়ে পড়ল?

আসুন প্রশ্নগুলোর উত্তর খূঁজতে বের হই। অবশ্যই দর্শনের যুক্তিতে। জুলিয়ান বাগিনি তার ” হাউ দ্যা ওয়ার্ল্ড থিংনক্স” বইতে তিনি এসব উত্তর খুজেছেন।

তার মতে, যেসব পূর্বএশিয়ানদের কথা বলেছি তাদের প্রধান দর্শন কনফুসিয়ানিজম। সাথে আছে বুদ্ধিজম, তাওইজম ও আরো কয়েকটি প্রধান চিন্তাধারা। এগুলোকে আপনি প্রথমত ধর্মচর্চার উতস হিসেবে দেখলেও সভগুলোর মূল সূর হারমোনি তথা ঐক্যতান। ঐক্যতানের ভাবানুবাদ ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একটি সুষম ও একক লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে চলবে। ভাল পিতৃ-মাতৃ স্নেহই ভাল সন্তান তৈরি করবে, ভাল শিক্ষক ভাল ছাত্র তৈরি করবে, ভাল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রজাদের জন্য ভাল কাজ করবে। এখানে হায়াররাকি সুনির্দিষ্ট। উন্নত ও গুণবান মানুষই সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল চাবিকাঠি। এ দর্শনগুলো মৃত্যু পরবর্তীকালের বিষয়গুলো পাশ কাটিয়ে কোন ঐশ্বরিক শক্তির কৃপা লাভের আশা না দেখিয়ে জীবনকালেই সঠিক পথের কথা আলোচনা করেছে। অর্থাৎ এগুলো ওয়ে টু লাইফ আফটার ডেথ নয় ওয়ে টু রাইট পাথ বিফোর ডেথ।

আধুনিক চায়নায় মাওইজম, ন্যাশনালিজম ও পরবর্তী উন্নয়ন দর্শনগুলো কনফুসিয়াস ও অন্যান্য প্রাচীন দর্শনকে অক্ষুণ্ণ রেখে এগোনোর আহবান করেছে এবং সংগতভাবেই হারমোনিকে গুলিয়ে ফেলেছে। আদতে এখন যা আছে সেটা আর হারমোনি না, সেটা ইউনিফরমিটি। সেদিক দিয়ে জাপানিজদের বর্তমান আধুনিক দর্শন একটি বিষ্ময়কর ব্যাপার। পশ্চিমের সব প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোগুলো গ্রহণ করেও তারা চাইনিজদের মত গুলিয়ে না ফেলে অনেকটাই স্বাতন্ত্র‍্যতা ধরে রেখেছে। হারমোনি খুব বেশি ইউনিফর্মিটির দিকে আগায় নি।

মি: বাগিনি বলেছেন , ভারতীয় দর্শন ও আরব দর্শন মূলত ধর্মকেন্দ্রিক দর্শন। এখানে দর্শন ও ধর্মকে আলাদা করাই কঠিন। সবজায়গায় ধর্মীয় টেক্সট হতে দিনে দিনে মারাত্বক ডেভিয়েশন হয়েছে। আসলে লিখিত টেক্সট সবার হাতে পৌছানো যায় না, সবাই এর মূল সূর অক্ষতভাবে পায় না। লিখিত টেক্সট ওরাল ফিলসফিতে রুপান্তর ঘটে, একেকজন নানা সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ডেভিয়েশন ঘটায়। যেমন -উপনিষদ ও পরবর্তী সমসাময়িক টেক্সটের ব্রাক্ষণ আর বর্তমান প্রচলিত ব্রাক্ষণ এক না। কোরানিক টেক্সটের পর্দা পোশাক আর আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় পর্দা প্রথা এক না। ইবনে সিনার মত অনেকের হাত ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেই সময়ের সর্বোচ্চ শিখরে উঠে সেটি আবার মুখ থুবড়ে পড়ে অটোমান সাম্রাজ্যসহ অন্যান্য রাষ্ট্রিয় শক্তির হাতে। ভুলভাল হাদিস, তাফসির, ফিকাহ এসব ত্বরান্বিত করে এবং ফতোয়া আসে শরীর ব্যবচ্ছেদ হারাম। যাহোক, ধর্মীয় দর্শণের মূল দূর্বলতা হলো জনমানুষ এগুলোর কোট আনকোট মর্মার্থ হাতে পৌছায় না বা তারা এর গভীরে পৌছাতে পারে না। বরংচ নান মুনী গুরু ঋষী মোল্লা মুরুব্বিদের নানামুখী ব্যাখ্যায় পড়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। প্রচলিত ধর্ম পালন করেও ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার আশেপাশেই যেতে পারে না। তদাপি দর্শন বা ধর্মের এ টেক্সটগুলো সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছে। একটা উদাহরণ দেই, ইসলামী টেক্সটগুলোয় শিক্ষকদের খুব সম্মান দেয়া হয়েছে। উপনিষদ পরবর্তী সময়ে গুরুগৃহের শিক্ষক প্রায় ভগবান সমতুল্য। তারা ভুলভাল করলেও মেনে না নেয়া পাপ হিসেবে দেখান হয়েছে। এগুলো আমাদের সমাজে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে।

অন্যদিকে গ্রিসে জন্ম নেয়া প্রাচীন পাশ্চাত্য দর্শন ইহকাল পরকাল কোনটার সন্ধান দেয় নাই। এগুলো খুজেছে কার্য ও কারণ, প্রশ্ন ও উত্তর। সক্রেটিস- প্লেটো -এরিস্টটল এর হাত ধরে এগিয়ে নিয়েছেন ডেকার্তে, কান্ট, নিটশে, মার্ক্সরা। দর্শন রুপান্তরিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক কার্যকরণে খোজায়। আধুনিক ব্যাখ্যাগুলো এসেছে নিউটন আইন্সটাইনদের হাত ধরে। পাশ্চাত্য দর্শনের উতকৃষ্ট প্রোডাক্ট হিসেবে দাবী করা হয় এনলাইটনমেন্ট, শিল্পবিপ্লব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও লিবারেল ডেমোক্রেসি। উপজাত হিসেবে এসেছে ভোগবাদীতা, ব্যাক্তি কেন্দ্রিকতা, নির্মম প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থা।

দর্শন গতিশীল। ধর্মীয় দর্শনগুলোর সাথে পশ্চিমা দর্শনের তুলনা করলে পশ্চিমা দর্শনগুলো স্বাভাবিক সুবিধা পেয়েছে একটি বেসিক পয়েন্টে। ধর্মীয় দর্শন চ্যালেঞ্জ করে নতুন উত্তর খুজতে চাইলে অথবা আপডেট করতে চাইলে গ্রুপ উপগ্রুপ মাজহাব ফেরকা তৈরি হয়। নয়েজ বাড়ে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শন গুলো চ্যালেঞ্জ করলে ও নতুন উত্তর খুজলে খুব বেশি ভাগাভাগি হয় না, নয়েজ কম ফলত কনফিউশন হয় না বললেই হয়। বরং আপডেট ও যুগোপযোগী হয়। ইউরোপিয়ান আইডিয়ালিজম নর্থ এমেরিকায় গিয়ে বড়জোর হয়েছে প্র‍্যাগমেটিজমে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দর্শনে ‘সেল্ফ’কে সংজ্ঞায়নে কালচারের প্রভাব প্রকট। এশিয়ান সেল্ফ হচ্ছে ইন্টিমেসি’ অর্থাৎ ব্যাক্তি সমাজের বা গ্রুপের অংশ। পশ্চিমা সেল্ফ হচ্ছে ‘ইন্টিগ্রিটি’ বা ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতা, ব্যাক্তিস্বাধীনতা। সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যাক্তিগত অধিকার ও মুল্যবোধকে উচ্চে তুলে ধরার কাজ করবে।

রাশিয়ানদের সেই অর্থে কোন গ্রুপেই ফেলা যায় না। না পাশ্চাত্য, না প্রাচ্য। এরা ততটাই পাশ্চাত্য যতটা পাশ্চাত্যকে বিরোধীতা করার জন্য লাগে। এদের দর্শন অনেকটাই ঘুরপাক খেয়েছে একসাথে থাকা, খাওয়া ও উতপাদনকে কেন্দ্র করে। আরেকটি কথা, লিখিত টেক্সট ফিলোসফিতে বামপন্থা খুবই নতুন। তাই একে ফেলে দেয়ার সুযোগ নেই। এখন সেই অর্থে শক্তিশালী না হলেও, ৫০/৫০০/২৫০০ বছর পর কি হবে কে জানে?

আমার মনে হয়েছে, ফিট ফর অল সল্যুশন বলে কিছু নেই। মনে রাখতে হবে হাজার বছরের চিন্তার বিবর্তনেই আজকের পৃথিবী। লিবারেল ডেমোক্রেসি, কমিউনিজম, সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা যে নামেই আপনি যে কোন তত্ব চাপিয়ে দেবেন আর তা খাপে খাপ মিলে যাবে তা হবার না। এ পথে বাধা ঐ ২৫০০ বছর আগের লিখিত টেক্সট ও তা হতে আপডেট বা ডেভিয়েশন করে পাওয়া বর্তমান লিখিত অলিখিত দর্শনগুলো। অর্থাৎ আউট অফ দ্যা বক্স কিছু করতে চাইলে আগে আরো বড় একটা বক্স বানিয়ে তারপর ছোট বাক্স হতে বের করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, ২৫০০ বছর আগের ও পরবর্তী সময়ের দর্শনগুলো একদিনে লিখা হয় নি। এগুলো এসেছে মানু্ষের ৩ লক্ষ বছরের অভিজ্ঞতায়। এগুলো পরিবর্তনশীল ছিল , থাকবে।


আপনার মতামত জানান