পীর-মুরিদির ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো পরিত্যাজ্য

প্রকাশিত




আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভের অন্যতম মাধ্যম পীর-মুরিদি। ইসলামের ইতিহাসে সুপ্রাচীনকাল থেকে পীর-মুরিদির পদ্ধতিতে তাসাউফ চর্চা হয়ে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে বহু দ্বিনি সংকট ও সমস্যাও আছে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি-সাধকদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার হওয়াই অত্র অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ভেতর পীর-মাশায়েখদের প্রভাব বেশি।

অন্যদিকে বিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞানের চর্চা কম হওয়া এবং স্থানীয় ধর্মমতগুলোর প্রভাবে উপমহাদেশের বহু পীরের দরবারে বাড়াবাড়ি ও বিকৃতি দেখা যায়। নিম্নে এমন কিছু বাড়াবাড়ি তুলে ধরা হলো।

১. বাইআতকে যথেষ্ট মনে করা : পীর-মুরিদির ক্ষেত্রে একটি বাড়াবাড়ি হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও পরকালে মুক্তির জন্য কারো হাতে বাইআত গ্রহণ করাকে ফরজ মনে করা। অথচ বাইআত হওয়া ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নতে মুআক্কাদা নয়; বরং এর সর্বোচ্চ স্তর মুস্তাহাব। আবার অনেকে পীরের হাতে বাইআত হওয়াকেই পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট মনে করে। এটাও এক ধরনের বিভ্রান্তি। বাইআত হলে শরিয়তের বাহ্যিক ও আত্মিক সব ধরনের বিধানের ওপর অটল থাকার প্রতিশ্রুতি নবায়ন করার নাম। এই বাইআত একাধিক হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

২. যাচাই ছাড়াই মুরিদ হওয়া : আত্মশুদ্ধির স্পৃহা জাগলেই কারো হাতে মুরিদ হয়ে যাওয়াও ভুল। কোনো পীরের হাতে বাইআত হওয়ার আগে শরিয়তের মানদণ্ডে তাকে যাচাই করে নেওয়া আবশ্যক। এমন ব্যক্তির হাতেই মুরিদ হওয়া প্রয়োজন, যার সংস্পর্শে থাকা যায়, যার সঙ্গে মহব্বত রাখা যায়, যার অনুসরণ করা যায়, যার সংস্পর্শ ও নির্দেশনায় নিজেকে সংশোধন করা যায়।

৩. গুনাহ ত্যাগের চেয়ে অজিফাকে বড় মনে করা : কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মূল বিষয় হচ্ছে ফরজ ও ওয়াজিব যথাযথভাবে আদায় করা, গুনাহ ত্যাগ করা এবং আত্মশুদ্ধি করা। শরিয়তের দৃষ্টিতে এগুলোই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়। বেশি বেশি জিকির ও নফল ইবাদত করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সওয়াবের কাজ হলেও তা দ্বিতীয় পর্যায়ের আমল। সুতরাং পূর্বোক্ত তিনটি বিষয়ে অবহেলা করে জিকির ও নফল ইবাদতে অধিক মনোযোগী হওয়া মারাত্মক ভুল।

৪. পার্থিব উদ্দেশ্যে মুরিদ হওয়া : পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য পীর বা মুরিদ হওয়া বৈধ নয়। পীর-মুরিদির উদ্দেশ্য হবে পথ প্রদর্শন করা ও সুপথ লাভ করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তবে বর্তমানে বহু মানুষ জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মুরিদ হয়। যেমন পীর তাবিজ-কবজে অভিজ্ঞ। প্রয়োজনের সময় তার কাছ থেকে তাবিজ নেওয়া যাবে। অথবা পীরের দোয়া কবুল হয়, ফলে মামলা-মোকদ্দমাসহ অন্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাঁকে দিয়ে দোয়া করাবে; পীরের মুরিদ হলে অন্য মুরিদদের দ্বারা ব্যাবসায়িক ফায়দা হাসিল করা যাবে ইত্যাদি। এ জন্য উদ্দেশ্য মুরিদ হওয়া অগ্রহণযোগ্য।

৫. মাসনুন দোয়া উপেক্ষা করা : বহু পীর মুরিদদের সবক প্রদানের ক্ষেত্রে মাসনুন দোয়ার পরিবর্তে বুজুর্গদের শেখানো দোয়ার প্রতি গুরুত্ব বেশি দেয়। এমনটি ভুল। কেননা মাসনুন দোয়া তথা যা সরাসরি আল্লাহর কালাম অথবা আল্লাহর রাসুলের মুখনিসৃত বাণী তার বরকত ও প্রভাব যেকোনো বুজুর্গের শেখানো দোয়ার চেয়ে বেশি। সুতরাং আল্লাহর বাণীর নুর ও বরকত হাসিলের জন্য মাসনুন দোয়াকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এর অর্থ এই নয় যে প্রচলিত এসব দোয়া পড়া যাবে না বা পাঠ করা নাজায়েজ। এসব দোয়ার স্থান মাসনুন দোয়ার পর।

৬. তাসাউফের উচ্চাঙ্গের কিতাব পড়া : সাধারণ মানুষের জন্য তাসাউফের উচ্চাঙ্গের কিতাব পড়া অনুচিত। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবি (রহ.) বলেন, একজন দ্বিনদার আলেম যিনি তাফসির, হাদিস, ফিকহ, মানতিক প্রভৃতি শাস্ত্র বিষয়ে পারদর্শী এবং যিনি তাসাউফ শাস্ত্রের কোনো যোগ্য বুজুর্গের সংশ্রবে ছিলেন—এ ধরনের আলেম ব্যক্তি যদি তাসাউফের উচ্চ ও সূক্ষ্ম বিষয়সংবলিত কিতাব পাঠ করে তবে কোনো সমস্যা নেই। বিপরীতে কোনো সাধারণ মানুষের জন্য এ কিতাবাদি দেখা দ্বিন-ঈমান ধ্বংসের কারণ হবে। তাদের জন্য এসব বই-পুস্তক দেখা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা তাসাউফের উচ্চাঙ্গের কিতাবে এমন কিছু বিষয় থাকে, যা তাদের কোনোভাবেই বোধগম্য হওয়ার নয়।

৭. হাদিস বর্ণনায় অসতর্কতা : পীর-মুরিদি তথা তাসাউফসংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে হাদিস বর্ণনায় একেবারেই অসতর্কতা অবলম্বন করা হয়। মুহাদ্দিসদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়—এমন কিতাবের হাদিস বর্ণনা করা উচিত নয়। কোনো বইতে থাকার অর্থই সেটা গ্রহণযোগ্য নয়; বরং তা যাচাই করে নেওয়া উচিত। বিশেষত আধুনিক যুগে হাদিস যাচাই করার অনেক সহজ মাধ্যম আছে। তাই বাছ-বিচার ছাড়া হাদিস বর্ণনা করা উচিত নয়।

৮. সুন্নতের ভুল অর্থ দাঁড় করানো : বহু পীর ও তাদের মুরিদরা সুন্নতের সঠিক অর্থ বুঝতে ভুল করেন। তারা সুন্নত বলতে দরবার কর্তৃক প্রচলিত বিশেষ ধরনের পোশাককেই ধরে নেয়। আবার কেউ পীরের অনুসরণ করতে গিয়ে সুন্নতকে ওয়াজিবের স্তরে অথবা সুন্নতে নিছক মুবাহ (বৈধ) বিষয়ের স্তরে নিয়ে যায়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন টুপি। এটি নববী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সুন্নত হিসেবে অনুসৃত হয়ে আসছে। কিন্তু হাদিসের বিশাল ভাণ্ডারে কোথাও বিশেষ প্রকারের কোনো টুপি চিহ্নিত করা হয়নি। বলা হয়নি এটাই সুন্নত। সুতরাং বিশেষ ধরনের টুপিকেই সুন্নত বলা ভুল হবে।

৯. স্বপ্ন ও ইলহামকে দলিল মনে করা : তাসাউফপন্থীদের একটি রোগ হলো, তারা স্বপ্ন, ইলহাম ও কাশফকে অপ্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ করে। এমনকি এসব বিষয়কে শরয়ি বিধানের বিপরীতে দলিল হিসেবে পেশ করে। অথচ এসব বিষয় শরিয়তের দলিল হওয়ার যোগ্য নয়। বিশেষত পীর বা পীরের ব্যাপারে নিজের স্বপ্ন দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট আমল, অভিমত ইত্যাদি শক্তিশালী বা দুর্বল প্রমাণের চেষ্টা করে। শরিয়তের দৃষ্টিতে স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহাম সুসংবাদ বা দুঃসংবাদের ইঙ্গিত মাত্র। শরিয়তের অনুকূল হলেই কেবল তার ওপর ব্যক্তিগতভাবে আমল করা যাবে।

১০. পীরের কথা-কাজকে দলিল মনে করা : বহু মুরিদ তার পীরের কাজকে শরিয়তের আলোকে যাচাই না করে, পীরের কথা-কাজকেই শরিয়তের দলিল মনে করে। তারা তাঁর সব কথা-কাজকে অনুসরণযোগ্য মনে করে। অথচ উলামায়ে উম্মত এ বিষয়ে একমত যে নবী-রাসুল ছাড়া আর কেউ নিষ্পাপ নয়। এমনিভাবে পীরের কথা ও কাজ শরিয়তের স্বতন্ত্র কোনো দলিল নয়। তবে যে পীরের বাহ্যিক ও আত্মিক আমল শরিয়ত ও সুন্নত মোতাবেক পরিচালিত, তিনি অবশ্যই অনুসরণযোগ্য।

তাসাউফ : তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ অবলম্বনে

আপনার মতামত জানান