নিয়ন্ত্রণহীন ভোট কেন্দ্র, ভোট স্থগিত

প্রকাশিত



গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট দেওয়ার গোপন কক্ষে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, একজনের ভোট আরেকজন দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঢাকা থেকে সিসিটিভিতে সরাসরি দেখার পর দুপুর ২টার দিকে ভোটগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের ওপর অংশীজনদের অনাস্থার বাতাবরণের মধ্যে নির্বাচন স্থগিতের শক্ত সিদ্ধান্ত নিল ইসি।


দেশে সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে পুরো আসনের ভোট বাতিল করার নজির নেই। ভোট স্থগিতের কারণ বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। আর ভোট স্থগিত করায় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, শুধু ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। তফসিল বাতিল করা হয়নি। ফলে নির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে। ভোটে কারচুপি ও অনিয়মের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করবে ইসি।

এদিকে গত রাতে ইসির এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ব্যাপক অনিয়ম ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার কারণে সব কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া অন্যরা নানা অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। এজেন্ট বের করে দেওয়া, কর্মী-সমর্থকদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোটগ্রহণ শুরুর সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে একযোগে চার প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাও দেন। এদিকে ভোটগ্রহণ বন্ধ করার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছেন।

ভোটার উপস্থিতি কম, অনিয়মের অভিযোগ

ভোটগ্রহণ শুরুর পর সকাল ১০টা পর্যন্ত বেশ কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোটারের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি থাকলেও তিন-চারজনের বেশি লক্ষ করা যায়নি। এ সময় প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। নির্বাচনের সময় সাঘাটার দই চড়া কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন আহত হয়। এরপর কেন্দ্রটি ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে মাইকিং করে ভোটারদের ভোট দিতে আসার আহবান জানানো হয়। কিন্তু তাতে খুব বেশি সাড়া মেলেনি।

ফলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, ভরতখালী উচ্চ বিদ্যালয়, রামনগর উচ্চ বিদ্যালয়, তেলিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি একই রকম। সকালে ভোট শুরু হওয়ার সময় কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল না। এ সময় প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। পরে প্রার্থীদের তোড়জোড়ে ভোটার কিছুটা বাড়লেও আবার তা কমতে শুরু করে।

চার প্রার্থীর ভোট বর্জন

অনিয়ম এবং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে দুপুরের দিকে জাপার এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্পধারার জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) এবং সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক) ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা স্কুল ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের কাছে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন তাঁরা।

গাইবান্ধা জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শাহজাহান খান আবু জানান, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সিসিটিভি লাগানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাকর্মীরা সিসিটিভির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কেন্দ্র তাঁদের দখলে নেন। এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রে জাতীয় পার্টির এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনের গাফিলতির কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই সুযোগ নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

সিইসির সংবাদ সম্মেলন

চার প্রার্থীর ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা দেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষাপটে আমরা ৫০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করি। রিটার্নিং অফিসারও একটি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করেন। বিষয়টি আমরা কমিশনের সব সদস্য বসে বিচার-বিশ্লেষণ করতে থাকি। আমরা নিশ্চিত হই যে ৫১টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি যেসব কেন্দ্র থাকে, সেখানকার পরিবেশ বিচার করে সঠিক মূল্যায়ন হবে না। ’

সিইসি বলেন, ‘আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কোনো একটি পক্ষ বা কোনো একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছেন। ফলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ হচ্ছে না। ’

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘আরপিওর ৯১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় ভোটগ্রহণ সঠিকভাবে হচ্ছে না, সুষ্ঠু হচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা পরিশেষে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরো নির্বাচনী এলাকা গাইবান্ধা-৫-এর ভোট কার্যক্রম আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। ’

সিইসি আরো বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়ে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিধি-বিধান অনুযায়ী কী করতে হবে, তা দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে। ’

অনেক কেন্দ্রে সিসিটিভির ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে সাংবাদিকদের জানান সিইসি।

ইসি সূত্র জানায়, এ আসনের ১৪৫ কেন্দ্রের সব কটিতেই এবার সিসিটিভি বসানো হয়েছিল; ঢাকার নির্বাচন ভবনে স্থাপিত পর্যবেক্ষণকেন্দ্র থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হয় ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি। নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ইসিতে বসে অনিয়ম-কারচুপির দৃশ্য দেখেন।

দুপুর ১২টার দিকে সাংবাদিকদের সিইসি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, অবশ্যই ভোটকেন্দ্রের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। কিছু অনিয়ম—গোপন কক্ষে অনধিকার প্রবেশ বা আইন ভঙ্গ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা দেখেছি। ’

নির্বাচনী কর্মীদের মধ্যে যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘আমরা যা দেখেছি তা আপনাদের জানাচ্ছি, মূল অ্যাকশনটা নিয়েছি। ভোট বন্ধ করে দিয়েছি। চাকরিবিধি অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেব, তা দেখছি। ’

এ ক্ষেত্রে ইভিএমের কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘এখানে মানবিক যে আচরণ, তা দেখিয়ে দিচ্ছে, একই রঙের পোশাক পরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এসব করছে। এটা সুশৃঙ্খল ভোটের পরিপন্থী। এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত। যারা আইন মানে না, তারা দুর্বৃত্ত। আমরা যদি সংস্কৃতির উন্নয়ন করতে না পারি, নির্বাচন কমিশন এখানে বসে বসে সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে? এটা সম্ভব নয়। ’

একটি আসনে ভোট করতে গিয়ে এই অবস্থা, ৩০০ আসনে ভোট হলে কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘এটা সময় বলে দেবে। এখন একটি আসনে সঠিক হচ্ছে না বলে ৩০০ আসনে হবে না, সেটি বলা সমীচীন হবে না। এই নির্বাচন থেকে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা যাবে। ’

ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন জেগে উঠছে, এটি ইতিবাচক। তাদের উপলব্ধি হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন করা ইসির দায়িত্ব। তাদের সেই ক্ষমতা আছে। প্রশ্ন হলো, একই ধরনের ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচনে ঘটলে তখন ইসি কী করবে?

গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ

উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে দুই উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিকেল ৩টার দিকে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজের নেতৃত্বে মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় তাঁরা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের সড়ক অবরোধ করেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসানের কর্মী-সমর্থকরা পরিষদের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। পরে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বোনারপাড়া এলাকার সাঘাটা উপজেলায় দলের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন। তিনি স্থগিত কেন্দ্র ছাড়া বাকি কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান।

আরপিওতে যা আছে

আরপিওর ৯১ ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন (ক) যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন না, তাহলে এটা যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমত, সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে; (খ) এই আদেশ বা বিধিমালার অধীন কোনো কর্মকর্তা কর্তৃক কোনো ব্যালট পেপার নাকচ বা গ্রহণসংক্রান্ত প্রদত্ত কোনো আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পারবে; এবং (গ) এই আদেশ ও বিধিমালার বিধান অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের যেকোনো নির্বাচন যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে পরিচালনা নিশ্চিতকরণের জন্য উহার মতে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি জারি করতে, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য আদেশ দিতে পারবে।

এ ছাড়া এ ধারায় উপধারাগুলোয় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন অনিয়মে জড়িতদের প্রার্থিতা বাতিল করতে বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে। কিংবা আবার তফসিল দিয়ে একেবারে শুরু থেকে পুরো নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।

ভোট বাতিলের নজির নেই

এর আগে সংসদীয় কোনো আসনের নির্বাচনে অনিয়মের কারণে পুরো ভোট বাতিল করতে হয়নি। চতুর্থ থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ছিলেন মিহির সারওয়ার মোর্শেদ। নির্বাচন কমিশনের এই অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের ৪০টির মতো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা যায়নি। তবে ওই সময় পুরো ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়নি। এবারের মতো এত সংখ্যক কেন্দ্র কখনো বন্ধ ঘোষণা করতে হয়নি। এ ছাড়া ভোট চলাকালে পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বন্ধ করার নজির নেই।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তাঁর জানা মতে ভোট বাতিলের নজির নেই। দেশের ইতিহাসে এটি নজিরবিহীন ঘটনা।

ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া গত ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে আসনটি শূন্য হয়।

আপনার মতামত জানান