তিন বন্ধুর মৃত্যুতে তিন পরিবারের স্বপ্ন শেষ!
গতকাল শুক্রবার সকালে গাজীপুর-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ি ফ্লাইওভারে প্রাইভেইকার-মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ হারান তিন বন্ধু রাজু, শামীম ও শাহীনুর। ছিলেন না রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু তিন জেলার তিন বাসিন্দা একই বাড়ির পাশাপাশি রুমে ভাড়ার থাকার সুবাদে হয়ে ওঠেন আত্মার আত্মীয়। পেশাগত কাজের সময় ছাড়া তিন বন্ধু একঙ্গে চলাফেরা করতেন, আড্ডা দিতেন আর ঘুরে বেড়াতেন। কে জানতো তাদের মৃত্যুও হবে একসঙ্গে!
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয় রাজুর আড়াই বছরের শিশু কন্যা রাইসা আক্তার। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়েছে তিন পরিবারের স্বপ্ন।
রাজু আহমেদ (২৫) সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বালসাবাড়ী মরিচা গ্রামের আয়নাল হকের একমাত্র ছেলে। মো. শাহিনুর রহমান (৩০) নীলফামারী সদরের সারেরতল এলাকার আবদুল রহিমের এবং বরগুনার বেতাগী পৌরসভার সেলিম মৃধার ছেলে একমাত্র ছেলে শামীম মৃধা (৩০)। তারা গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ির দেওয়ালিয়া বাড়ি এলাকার মো. আসলামের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। শামীম ও শাহিনূর গার্মেন্টে চাকরি এবং রাজু বাবার সঙ্গে মহাসড়কে মাটিকাটার কাজ করতেন। তারা ভাড়া বাসা থেকে শাহিনুরের মোটরসাইকেলে করে পাশের বাইমাইল এলাকায় রাজুর বাবার বাসায় যাচ্ছিলেন। একসঙ্গে তিন বন্ধুর মৃত্যুতে এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। পরিবারে চলছে মাতম। তাদের আয়ে চলতো বাবা-মাসহ পরিবারের ভরণপোষণ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোনাবাড়ী থানার এসআই সাখাওয়াত ইমতিয়াজ জানান, সকাল ১১টার দিকে কোনাবাড়ী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে একটি মোটরসাইকেলযোগে হতাহতরা বাইমাইলের দিকে যাচ্ছিলেন। কোনাবাড়ী নতুন বাজার এলাকায় পৌঁছলে বিপরীত দিকে থেকে আসা একটি প্রাইভেটকারের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থেকে শাহীন ও শামীম ফ্লাইওভারের ওপর থেকে ছিটকে নিচে পড়েন। রাজু ও তার মেয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পড়ে থাকে। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাজু, শাহীন ও শামীমকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আহত শিশু রাইসাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। মোটারসাইকেলের বাবা রাজুর কোলে ছিল রাইসা।
বাবা আয়নাল হক জানান, কোরবানির মাংস এবং মেয়ে রাইসাকে নিয়ে ছেলে রাজু তার বাসায় এসেছিলেন। জানতে পেরে বন্ধু শাহীনুর ও শামীমও আসার বায়না ধরেন। তারা শাহীনূরের মোটরসাইকেলে করে আসছিলেন। রাজুর কোলে রাইসা এবং মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন শামীম। কে জানত প্রাইভেটকার এসে তিনপ্রাণ কেড়ে নিয়ে তার বুক খালি করবে। একমাত্র নাতনি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। মর্গের সামনে আহাজারি করছেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ। স্বপ্ন ছিল বাবা-ছেলে মিলে রোজগারের টাকায় গ্রামে বাড়ি করবেন। এখন সব ধুলিসাৎ হয়ে গেছে।
শাহীনুরের বন্ধু তুহিন জানান, শামীম, শাহীনূর ও তিনি একসঙ্গে স্থানীয় রহমত গ্রুপের একটি গার্মেন্টে কাজ করতেন। চার ভাইবোনের মধ্যে শাহীনুর ছিল বড়। তার নয় বছরের একটি ছেলে রয়েছে। সংসারে আয়ের আর কেউ ছিল না। স্ত্রী মুন্নী ও শাহীনূর মিলে চাকরি করে সংসার চালিয়ে গ্রামে বৃদ্ধ বাবা-মার জন্য টাকা পাঠাতেন। রোজগার থেকে অল্প অল্প জমিয়ে ছয় মাস আগে শখ করে মোটরসাইকেলটি কিনেছিল শাহীনূর। শখের মোটরসাইকেলই কেড়ে নিল তার প্রাণ।
ভগ্নিপতি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শামীম ছিল দ্বিতীয়। বাবা মা দুজনই অসুস্থ। মূলত তার রোজগারের টাকায় চলতো বাবামার সংসার। তার ৫-৬ বছরের একটি মেয়ে আছে। এই দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দিয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) মো. জাকির হাসান জানান, দুর্ঘটনার পর প্রাইভেটকারের চালক আশরাফুল আলমকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে
আপনার মতামত জানান