ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং : ১০ হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত

প্রকাশিত


বাংলাদেশের উপকূলে গত সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবল বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাসে দেশের ১৯ জেলার প্রায় ৫৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারা দেশে ৪১৯টি ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ও পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানিতে ভেসে গেছে হাজারখানেক মাছের ঘের।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সূত্রে এই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জানা যায়। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়। এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। আরো ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান, অতিরিক্ত সচিব বেগম রওশন আরা এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) পরিচালক আহমেদুল হক। তবে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর তথ্য নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানান, দেশের ছয় হাজার হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া মারা গেছে ৯ জন। এর মধ্যে আটজনই গাছচাপায় মারা গেছে।

ঘূর্ণিঝড়টি বরগুনা ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পূর্বাভাস ছিল। পরে এটি আরো উত্তর-পূর্ব দিকে বাঁক বদল করে পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতির পুরো হিসাব দিতে আরো সময় লাগবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

এ ব্যাপারে মো. এনামুর রহমান বলেন, “নিয়ম আছে যে দুর্যোগের পর মাঠ প্রশাসন একটা জরিপ করবে। তারপর জেলা পর্যায়ে ডিসিরা ‘ডি’ ফর্মের মাধ্যমে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। একটি আন্ত মন্ত্রণালয় সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ক্ষয়ক্ষতি উপস্থাপন করবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা সহায়তা ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু করব। এটা সম্পন্ন করতে সাত থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। ”

কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি

কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ে দেশের মোট ৫৮ হাজার ৯০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন রয়েছে ৩৩ হাজার ৭০০ হেক্টর এবং শীতকালীন সবজি ও অন্যান্য শস্য রয়েছে ২৫ হাজার ২০০ হেক্টর জমির। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খুলনায়। এই জেলায় ১১ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট হাজার ৯৪২ হেক্টর এবং সবজি ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি দুই হাজার ৩৪১ হেক্টর জমির। এরপর রয়েছে নোয়াখালী। এই জেলায় ছয় হাজার ১৫২ হেক্টর জমির ধান ও অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রামে পাঁচ হাজার ২৪৬ হেক্টর, বরিশালে চার হাজার ৪৪৯ হেক্টর, চাঁদপুরে তিন হাজার ৮৫০ হেক্টর এবং বাগেরহাটে তিন হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনা জেলায় ১৭ হাজার হেক্টর জমির আমন ধান ঢলে পড়েছে। এর মধ্যে রোপা আমনের ক্ষতি প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির। ঝোড়ো বাতাস ও পানির কারণে জেলায় ধানসহ বিভিন্ন ফসল আক্রান্ত হয়েছে। দ্রুত কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট ও বাঁধ

প্রাথমিক হিসাবে সারা দেশের ৪১৯ ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার বসতবাড়ি আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে গ্রামীণ সড়কগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উপকূলের সব উপজেলার বাঁধ কমবেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। বরগুনায় সিত্রাংয়ের আঘাতে ৯৭২টি বসতঘর আশিংক ক্ষতিগ্রস্ত ও ৬৮টি বসতঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। গাছচাপায় একজন মারা গেছে। বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে গাছপালা পড়ে এবং ভারি বৃষ্টিপাতে জেলার বিভিন্ন এলাকায় দুই হাজার ১৪০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ বিষয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাতাসে গাছপালা উপড়ে পড়ে এবং ভারি বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে দুই হাজার ১৪০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩২২টি পুরোপুরি এবং এক হাজার ৮১৮টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে।

আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছে মানুষ

সিত্রাংয়ের কারণে ছয় হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদে আনা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার পর মধ্যরাত থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। সকালের মধ্যে সবাই আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করে।

এ বিষয়ে খুলনার কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, সিত্রাংয়ের প্রভাব কেটে যাওয়ায় সকাল থেকে আশ্রিত লোকজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। উপজেলার ১১৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৩ হাজার এবং অন্যান্য স্থাপনায় আরো ৯ হাজার মানুষ ঠাঁই নিয়েছিল।

সচল হয়নি মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক

বিটিআরসির তথ্য মতে, ঝড়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরদের প্রায় সাত হাজার ৩৪২টি টাওয়ার/সাইট বন্ধ বা বিকল হয়ে যায়। এর মধ্যে গতকাল সকাল পর্যন্ত এক হাজার ৫২৮টি সচল করা সম্ভব হয়েছে।

অন্যদিকে তিন বেসরকারি অপারেটরের তথ্য মতে, গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের পাঁচটি বিভাগে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনা) প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০টি টাওয়ার/সাইট অচল ছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় জেনারেটর ও ব্যাটারি দিয়ে সচল রাখার চেষ্টা চলছিল আট হাজার ৮০০টি টাওয়ার ও সাইট।

পানির নিচে খাতুনগঞ্জ

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে মাঝরাতে জোয়ারের পানি ঢুকে যাওয়ায় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। রাত ১২টার পর জোয়ারের পানি প্রবল বেগে চলে আসায় ৪০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে যায়। এতে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।

স্বাভাবিক নৌচলাচল ও বিমানবন্দর

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, গতকাল সকাল পৌনে ১০টা থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ সব নৌপথে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া তিন বিমানবন্দরও সচল হয়েছে।

গতকাল দুপুর ১২টা থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরে উড্ডয়ন ও অবতরণ স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

ঘূর্ণিঝড়ের ধকল কাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে সকালে জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে। গতকাল দুপুর থেকে পণ্য ওঠানো-নামানো শুরু হয়েছে। পুরোদমে সচল হয়েছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুপুর ১২টা থেকে বিমান ওঠানামা শুরু হয়।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ঝুঁকি এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে থাকা সব জাহাজকে সোমবার সাগরে পাঠিয়ে জেটি নিরাপদ রাখা হয়। সতর্কসংকেত কমে আসায় সেই জাহাজগুলো জোয়ারের সঙ্গে মিল রেখে বন্দর জেটিতে আসা শুরু করে। এখন পুরোদমে সচল হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং গত সোমবার মধ্যরাতে ভোলার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে। বৃষ্টি ঝরিয়ে দ্রুত দুর্বল হয়ে যায় সিত্রাং। এ জন্য মোংলা, পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৭ নম্বর বিপত্সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়। কক্সবাজারকে ৬ নম্বর বিপত্সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা। ]

আপনার মতামত জানান