গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ প্রথম শুরু হয় যশোরে। এখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় সাতক্ষীরায়। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার সৈয়দ মামুদপুর গ্রামের সফল টমেটো চাষি শহর আলী জানান, চলতি মৌসুমে ৩০ শতক জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আগে ধান, পাট, বেগুন চাষ করতাম। তাতে পড়তা হতো না। সংসারে অভাব ছিল।
টমেটো চাষ করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাইছি। জমি কিনিছি, আবার টিনশেড দিয়ে পাকা বাড়িও করিছি। এখন অনেক ভালো আছি। ’
শহর আলী বারি-৮ জাতের টমেটো চাষ করেছেন। এক শতক জমিতে বারি টমেটো-৮ চাষ করে উৎপাদন খরচ বাদে প্রায় ৯ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্রে জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাটে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতেও আবাদ করা হচ্ছে এই টমেটো। গত বছর সাতক্ষীরা জেলায় ৭০ হেক্টর জমিতে টমেটো আবাদ করা হয়েছিল, চলতি বছরে তা ৯৫ হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। গত বছর যশোরে ৩১ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হলেও চলতি বছরে তা ৫০ হেক্টর ছাড়াতে পারে। শীতকালীন টমেটো প্রতি হেক্টরে ১০ থেকে ১৫ টন ফলন দিলেও গ্রীষ্মকালীন বারি টমেটোর ফলন হেক্টরে ৪০ টন।
২০২১-২২ অর্থবছরে সারা দেশে ৪৮১ হেক্টর জমিতে ১৩ হাজার ৬৭৩ টন গ্রীষ্মকালীন টমেটো উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ টন রপ্তানিও করা হয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি টমেটোর ভোক্তা পর্যায়ে গড় দাম ৭৫ টাকা হিসাবে নিলে এর বাজার শতকোটি টাকা ছাড়ায়। তবে স্বল্প সময়েই গ্রীষ্মকালীন টমেটোর বাজার হাজার কোটি টাকা করা সম্ভব।
পাঁচ বছরের মধ্যে উৎপাদন ৩০ হাজার টন ছাড়ানোর পরিকল্পনা ডিএইর।
কৃষিসচিব মো. সায়েদুল ইসলাম জানিয়েছেন, গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষকদের বীজ, সারসহ প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেওয়া হবে। টমেটোর ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে ভরা মৌসুমে টমেটো আমদানি বন্ধ রাখা হবে।
১৯৯৫ সালে যশোরের বাঘারপাড়ার মো. নূর মোহাম্মদ নামের একজন কৃষকের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদ শুরু হয়। এখানে পাইলট আকারে আবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন বারির সেই সময়ের কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ। সেই থেকে যশোরের বাঘারপাড়া গ্রীষ্মকালীন টমেটোর উৎপত্তিস্থল। মূলত ইনব্রিড (উফশী) জাতের মাধ্যমে এই টমেটোর আবাদ শুরু করা হলেও পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে হাইব্রিড জাত এসেছে। এখন কৃষকের সবচেয়ে বেশি মুনাফা দিচ্ছে গ্রীষ্মকালীন টমেটো।
বারির খুলনা অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ বলেন, এক বিঘা জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো আবাদ করতে দুই লাখ থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এসব টমেটো বিক্রির মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব। একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করতে পারেন। গ্রীষ্মকালে এত লাভ আর কোনো শস্যে সম্ভব নয়।
হারুনুর রশিদ বলেন, গ্রীষ্মকালে ভারত থেকে যে টমেটো আনা হয়, সেটির চামড়া পুরু এবং রস কম। স্বাদও কম। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন টমেটোর রস যেমন বেশি থাকে, তেমনি কিছুটা টক থাকায় স্বাদ বেশ ভালো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আবাদ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে পলিথিনের শেড, উন্নত ড্রেনের ব্যবস্থা কৃষকের জন্য জটিলতা তৈরি করছে। এ ছাড়া ফসল-উত্তর ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, রোগমুক্ত বীজের ও উন্নত জাতের অভাব, দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থার কারণে কৃষককে গ্রীষ্মকালীন টমেটো বাজারজাত করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, ‘আমরা কৃষকের কাছে জাত পৌঁছে দেওয়া এবং উদ্দীপনা তৈরির পাশাপাশি আবাদ পদ্ধতির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। বীজসহ কারিগরি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হাজার হেক্টরে উন্নীত করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া টমেটোর বীজ যাতে কৃষকরা নিজেরাই তৈরি করতে পারেন সে জন্যও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, এই টমেটোর বিপণন বাধা দূর করা সম্ভব হলে উৎপাদন ৫০ হাজার টনে উন্নীত করা সম্ভব হবে।
গ্রীষ্মকালীন টমেটোর আবাদে সবচেয়ে বড় অবদান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি)। পাশাপাশি বেসরকারি বেশ কিছু কম্পানিও জাত উদ্ভাবন করেছে। বারি এযাবৎ টমেটোর ৩২টি জাত উদ্ভাবন করেছে।
আপনার মতামত জানান