আজ পহেলা আষাঢ় সুরেলা বৃষ্টিতে রচিত হোক বর্ষামঙ্গল
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বৃষ্টিকে বলেছিলেন ‘মাতাল মিউজিক’। বৃষ্টির সঙ্গে প্রকৃতি ও ফসলের যেমন হৃদ্যতা, তেমনি শিল্প-সাহিত্য, সংগীতেরও গলাগলি সম্পর্ক। অবিরাম ধারায় যখন রোদন-রূপসী বৃষ্টি ঝরে, তখন তা হয়ে ওঠে প্রকৃতির অনুপম সংগীত। রিমঝিম তার তাল-লয়।
ঝরো ঝরো স্পন্দন তার বাণী। বর্ষার সুর ও বাণীতে স্নিগ্ধ ও স্নাত হওয়ার দিন সমাগত। আজ শনিবার ১৪২৬ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ের প্রথম দিন। সৌন্দর্যমণ্ডিত, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা আষাঢ়—তোমায় স্বাগত।
প্রকৃতিতে বর্তমানে কাঠফাটা তীব্র দাহ। তীব্র এই দাবদাহে মানুষের হাঁসফাঁস দশা। আর এ সময় একটুখানি বৃষ্টি যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ। প্রকৃতির দরজায় কয়েক দিন ধরেই কড়া নাড়ছিল বর্ষা ঋতু। আজ খুলে গেল আগল। রুক্ষতাকে বিদায় জানিয়ে কোমল হয়ে উঠুক প্রকৃতি। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে পেখম মেলুক ময়ূর। বনে বনে ফুটুক নানা রঙের ফুল। পুকুর, দিঘি, খালবিল কানায় কানায় ভরে উঠুক বৃষ্টিধারায়। ফসলের মাঠে হাসি ফুটুক কৃষকের। আবার অতি বর্ষাও ক্ষতিকর। বন্যার শঙ্কা থাকে। তাই প্রার্থনা, পরিমিত বৃষ্টি হোক। আমাদের যতটুকু বৃষ্টি দরকার, প্রকৃতি আমাদের ততটুকুই বৃষ্টি দিক।
আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। বর্ষাকাল মানে মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ ও জেগে ওঠার গান। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন—‘এই জল ভালো লাগে;—বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ—বুলায়ে দিয়েছে চুল—চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,—আবেগের ভরে।’ বর্ষার অনুপম সুরে গেয়ে ওঠে প্রকৃতি, নেচে ওঠে মন। তৃষিত হৃদয়ে পুষ্পে-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের নতুন গানের সুর নিয়ে আসে।
আষাঢ়-শ্রাবণের বহুমাত্রিক রূপবৈচিত্র্য নিয়ে বাংলায় রচিত হয়েছে অজস্র গান-কবিতা। বর্ষার বিচিত্র ও সার্থক ব্যবহার হয়েছে গল্প-উপন্যাসে। বাল্মীকি থেকে কালিদাস হয়ে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বর্ষা ঋতুর যে বর্ণনা, যে আবেদন, তাতে প্রকৃতির এই বিশেষ সময়কালের রূপমাধুরী উঠে এসেছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথের হাতে বর্ষা রূপ পেয়েছে প্রকৃতির রোমান্টিক প্রতিমা হিসেবে। বর্ষা ঋতুকে তিনি কবিতা-গানে তুলে ধরেছেন বহুবর্ণিল অবয়বে। অসংখ্য গান, কবিতা, ব্যক্তিগত চিঠিসহ নানা লেখায় কবিগুরু বর্ষাকে মহিমান্বিত করেছেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে।’ কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘বর্ষাকে আমি ভালোবাসি আমার প্রিয়জনের মতো করে।’ বর্ষা নিয়ে বাংলা ভাষার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার সবাই দারুণ সব শিল্প-সাহিত্য রচনা করেছেন।
শহর নয়, বর্ষা উপভোগের জন্য গ্রামই আদর্শ। নাগরিক জীবনে বর্ষা উপভোগ বলতে ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা স্পর্শ। বড়জোর ছাদে একপশলা বৃষ্টিতে ভেজা। একই সঙ্গে এটাও বলতে হয়, পরিকল্পনাহীন বেড়ে ওঠা জনবহুল এই নগরে বৃষ্টিবিলাসের চেয়ে কষ্টই বাড়ায় বেশি। তবু ঝুম বৃষ্টিতে বাঙালির জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়। আজও ঘরে ঘরে জমে ওঠে আষাঢ়ের গল্প। অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে মুড়ি-চানাচুর-বাদাম ভাজা। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উদাসী হয়ে পড়েন কেউ কেউ। ফিরে যান শৈশব-কৈশোরে, গ্রামের মেঠোপথ বা আঙিনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভেজা আর উদ্বিগ্ন মায়ের বকুনি খাওয়ার মধুরতম দিনগুলোতে। কারো বা মনে হবে ‘এমন দিনেই তারে বলা যায়…’ হৃদয়ের কথা। আমাদের ক্লান্ত তপ্ত জীবনে আশীর্বাদের মতো ঝরে পড়ুক বৃষ্টিধারা। রচিত হোক বর্ষামঙ্গল।
লেখক : নওশাদ জামিল
সিনিয়র রিপোটার
দৈনিক কালের কন্ঠ
আপনার মতামত জানান