অমান্তিকার মৃত্যু মধ্যবিত্তের অসহায় পরিনতি

প্রকাশিত

ডেইলি সোনারগাঁ >>
অমান্তিকার মৃত্যু প্রমান করে কতটা লাগামহীন সোনারগাঁ তথা বাংলাদেশের বেসরকারি ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় সোনারগাঁ শপিং কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায় দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে সোনারগাঁ জেনারেল হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ প্রায় ২২টি ক্লিনিক। এখানেই বাঁচতে এসেছিলো আমান্তিকা। কিন্তু ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় ফুটফুটে কন্যা শিশুকে রেখে বিদায় নিতে হলো। এ দায় কার? জবাব নেই।

শুধু বলবো প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তার অভাব, পরিদর্শন ও তদারকির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি এবং মালিকদের অতি-মুনাফা লোভ রোগীর মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া দেখা যায় সোনারগাঁয়ের অলিতে গলিতে ক্লিনিক আর ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। খন্দকার প্লাজার দোতলায় মাত্র ১০ফিট বাই ১৪ ফিটের ছোট্ট একটি কক্ষে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক। এর পিছনে বাড়িমজলিস যেতে একটি ব্যাচেলার রোম ভাড়া করে চলে ক্লিনিক। যেখানে শুধু অবৈধ চিকিৎসার মাধ্যমে ভ্রুণ কিংবা বাচ্চা নষ্ট করা হয়। ভাবা যায়, ছোট্ট চৌরাস্তার মতো জায়গায় প্রায় ৩৩টি ক্লিনিক। আর এসব ক্লিনিকে রোগী আসার সাথে সাথে স্যালইন পুশ করে ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার আসার আগ পর্যস্ত স্যালাইন রোগীর একমাত্র ভরসা। সিজারের ক্ষেত্রে একজনই ভরসা নূরজাহান। এক ক্লিনিকে সিজার করছেন অন্যক্লিনিকে আরেকটি সিজারের ডাক। গজ, তুলা, ছুড়ি, কাচি রোগির পেটে রেখে নার্সকে সেলাইয়ের কথা বলে দৌড়। আর নার্স সবকিছু পেটে রেখেই সেলাই করে দিচ্ছে। কারন নার্সকে তো বলা হয়নি এগুলো বের করে নিতে। নার্স ভেবেছে ম্যাডাস হয়তো রোগীর ভালোর জন্যই এগুলে পেটে রেখেছে। পরিনতি আমান্তিকার মৃত্যু।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স জানান, নূরজাহান ম্যাডামের এমনও সময় যায়, তিনি দৈনিক ২০/২৫টা সিজার করেন। সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, বন্দর, মদনপুর, চিটাগাংরোডে তিনি নিয়মিত সিজার করেন। ওনি আসার আগ পযন্ত স্যালাইন আসার সাথে সাথে সিজার। সিজার শেষ একমিনিট ও অপেক্ষা নয়, অন্য ক্লিনিকে।

সে কারনেই উপজেলা পর্যায়ের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনিয়মের প্রবণতা অধিকতর লক্ষণীয়। অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতির ঘাটতিসহ সার্বিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় সেবাগ্রহীতারা সঠিক ও মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিক ও স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

টিআইব’র গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে থেকে জানা যায়, এসব ক্লিনিকের নিবন্ধন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, মালিক বা অংশীদারদের প্রভাব-প্রতিপত্তির ওপর এ অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিদর্শনের তারিখ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে পূর্বেই জানিয়ে দেওয়া হয় এবং সে অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান ওই নির্দিষ্ট দিনের জন্য জনবল ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সঠিক রাখে।

দেশ ডিজিটাল হলেও চিকিৎসা সেবার আইন সে বৃট্রিশ আমলের। অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ করার কোনো আইন নেই। আবার বিভিন্ন বিষয়ে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবাগ্রহীতার আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বাক-বিতন্ডা, সংঘাত ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটলেও সেবা প্রদানকারীর নিরাপত্তা এবং প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই।

একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, কৌশলগত কারনে এক শ্রেনির ব্যবসায়িরা এসব ক্লিনিকে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের অংশিদার করে।হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগী পেতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্স, পল্লী চিকিৎসক ও মেডিকেল প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও মালিকদের একাংশসহ পরিবার পরিকল্পনাকর্মী, ফার্মেসীর ওষুধ বিক্রেতা, ধাত্রী, বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের রিসিপশনিস্ট, রিক্সাচালক ও পেশাদার দালালদের মোটা অংকের টাকা কমিশন দিয়ে এসব ক্লিনিকে রোগী আনা হয়।

উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ হাসপাতালের নিজস্ব চিকিৎসক নেই। অধিক মুনাফা অর্জনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক সময় প্রসূতিকে সিজারিয়ান প্রসবে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও, অধিক মুনাফার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবাগ্রহীতার অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অতিরিক্ত ওষুধ ক্রয়ের পরামর্শ প্রদান করা হয়। অনেক সময় পরীক্ষা না করেই প্রতিবেদন তৈরি করার প্রমান মিলেছে। গরিব নিরিহ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।

সোনারগাঁ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেড( সহকারি কমিশনার, ভুমি)সহ সকলের সমবেত প্রচেষ্টাই গরিব, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক:
সম্পাদক, ডেইলি সোনারগাঁ অনলাইন ডট কম।

আপনার মতামত জানান