নারায়ণগঞ্জে হত্যা মামলা, বাদী জানেই না তিনি মামলার বাদী

প্রকাশিত

বিশেষ প্রতিনিধি
বাদী নিজেই জানেন না সে মামলার বাদী। চেনেন না আসামিকেও। গত ৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত-আহতদের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বাদীর কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে দায়ের করা হচ্ছে মামলা।


ফলে প্রকৃত আসামিরা পার পেয়ে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
সম্প্রতিক নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাতেও অসংখ্য হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই দুই মামলার বাদীর অভিযোগ, নজরুল মাদবর নামের এক বিএনপি নেতা সরকারি সহায়তার কথা বলে সাদা কাগজে তাদের সই নেন।


পরে থানায় জমা দেওয়ার কথা বলে মামলা করেন।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, গত ২২ জুলাই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ফতুল্লার ভুঁইগড় কাজীবাড়ি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আব্দুর রহমান (৬০) নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ী মারা যান। পরে এ ঘটনায় গত ৮ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়। মামলার বাদী ছিলেন তার ছেলে ফয়সাল (৩৪)।

আর গত ৪ আগস্ট মাদরাসাছাত্র আবু তালহা (১৬) গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার ঘটনায় একইদিন অর্থাৎ গত ৮ সেপ্টেম্বর ফতুল্লা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের হয়। এই মামলার বাদী ছিলেন আহত তালহার বাবা এইচএম কামাল উদ্দিন (৪৫)। উভয় মামলাতেই ২২৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়।
এদিকে, দুই মামলারই বাদী নিজেদের দায়েরকৃত মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন বলে দাবি করেন এবং এর সঙ্গে নজরুল ইসলাম মাদবরকে দোষী করেন। অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম মাদবর ফতুল্লা থানা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ও কুতুবপুর ইউনিয়ন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।

তিনি কুতুবপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ছিলেন।
মামলার বাদী এইচএম কামাল উদ্দিন বলেন, আমার মামলা করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। কিন্তু ওই নজু মাদবর আমার কাছে এসে বলেন, আপনার ছেলে যেহেতু গুরুতর আহত হয়েছে, এই বিষয়টা থানায় জানাবো। পরবর্তীতে অনেকেই আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমি নাকি মামলা করেছি। কিন্তু আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। কয়জনের বিরুদ্ধে এবং কাকে আসামি করা হয়, তা আমি এখনো জানি না। পরবর্তীতে মামলা প্রত্যাহার করার বিষয়ে আমি থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ আমাকে জানায়, তদন্ত সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে এই মামলা বাদ করা হবে। তদন্ত শেষ করার আগেই মামলা প্রত্যাহার করা যাবে না।

হত্যা মামলার বাদী মো. ফয়সাল বলেন, আমার বাবা আন্দোলনে চলাকালীন সময়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন অনেকেই আমাকে মামলা করতে বলেছিল। কিন্তু আমি কোনো মামলা দায়ের করি নাই। তখন আমাদের এলাকার নজু মাদবর সরকারি সহায়তা, ত্রাণ হিসেবে আমাদের কিছু দিবেন। তখন তিনি আমার আইডি কার্ডের ফটোকপি আর একটা কাগজে আমার সই নেন। এরপর থেকেই আমি শুনে আসছি, আমি নাকি বাদী হয়ে মামলা করেছি।

তিনি বলেন, মামলা প্রত্যাহার করে নিতে চাইলে পুলিশ আমাকে জানায়, যেহেতু তার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সে কারণে এই ঘটনায় এমনিতেও মামলা দায়ের হতো।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ডিবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আঙ্গকুর ভট্টাচার্য বলেন, আমি আব্দুর রহমান হত্যা মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা। এর আগে দুজন এই মামলার তদন্ত কাজ করে। তার ছেলে ফয়সালকে না জানিয়েই এই মামলা দায়ের করা হয়েছে, এই ঘটনা আমি শুনেছি। তবে হত্যার ঘটনাটি সঠিক। তাই এই মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, তবে নিরপরাধ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, আমরা সেক্ষেত্রে সতর্ক রয়েছি। এরই মধ্যে আমরা আব্দুর রহমানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছি। শিগগিরই এই মামলার চার্জশিট বিজ্ঞ আদালতে জমা দেওয়া হবে। যারা এই ঘটনায় জড়িত প্রমাণিত হবেন, শুধু তাদেরকেই অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রদান করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অভিযুক্ত বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মাদবরকে একাধিক ফোন এবং খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি তাতে সাড়া দেননি।

ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম টিটু বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই। মামলা বাণিজ্যে আমাদের বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসন যেন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমরা সে সহযোগিতা প্রশাসনকে করবো।

ফতুল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, মামলা দায়ের হওয়ার পর যদি কোনো বাদী দাবি করেন তার অগোচরে মামলা দায়ের হয়েছে কিংবা মামলার বিষয়টি তিনি জানেন না, আমরা তা আমলে নিচ্ছি না। আমরা শুধু মামলার ঘটনা, এজাহারনামীয় আসামি এই বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখছি।

তিনি আরো বলেন, যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে এবং যারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে কোর্টে অভিযোগপত্র দায়ের করা হবে। পরে বাদী মামলা চালাবে কিনা তা কোর্ট দেখবে। আর মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কারো বিরুদ্ধে থানায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আপনার মতামত জানান