বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে কোথায় কোন ওলি এসেছেন
ইতিহাস থেকে জানা যায়, একদল সাহাবি আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওয়াহাব (রহ.)-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে চীনে আগমন করেন।
এরপর একে একে আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে পীর, ফকির, দরবেশ, ওলি-আউলিয়া ও সুফি সাধকদের এ দেশে আগমন ঘটতে থাকে। তবে ১১ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়।
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম বিজয়ের আগে খ্রিস্টীয় ১১-১২ শতাব্দীতে যেসব গাউস, কুতুব, সুফি-সাধক এ দেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—
শাহ সুলতান রুমী (রহ.) (১০৫৩ খ্রি./৪৪৫ হি.) নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে ইসলাম প্রচার করেন। নেত্রকোনার মদনপুরে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
বাবা আদম শহীদ (রহ.) (১০৯৯-১১৭৮খ্রি.) বিক্রমপুর, ঢাকা, পাবনায় ইসলাম প্রচার করেন। মুন্সীগঞ্জ জেলার দরগাবাড়ী গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদের আঙিনায় তাঁর মাজার রয়েছে।
শাহ সুলতান বলখি মাহি সওয়ার (রহ.) বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ সুফি-সাধক ও ইসলাম প্রচারক। সন্দ্বীপ, ঢাকা ও বগুড়ায় ইসলাম প্রচার করেন। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে। তিনি কখন বাংলায় প্রবেশ করেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয়, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সামরিক নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের আগেই তিনি বাংলায় প্রবেশ করেন।
খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের স্বর্ণযুগ বলা যায়। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকায় শাসকশ্রেণির সঙ্গে বহু পীর-দরবেশ এ দেশে আগমন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজিত হলে ইসলামের শরিয়ত ও মারেফত উভয় ধারার প্রচার ও প্রসার তীব্রতর হয়। মুসলিম বিজয়োত্তর যেসব সুফি-সাধক ইসলাম ও তরিকা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—
শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) (১১৭৪-১২৬৯ খ্রি.) বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি চট্টগ্রামে শেখ ফরিদউদ্দিন চশমা এবং ফরিদপুরে শেখ ফরিদ নামে সুপরিচিত।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পাঠপাটান জেলায় তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
শেখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (-১২৭৮ খ্রি.) নারায়ণগঞ্জে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ এবং এর আশপাশে ইসলাম প্রচার করেন। সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ার দরগাহবাড়ি প্রাঙ্গণে খানকাহ ও মাদরাসাস্থলের সন্নিকটে গোরস্তানে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
সৈয়দ শাহ তুরকান শহীদ (রহ.) (-১২৮৮ খ্রি.) রাজশাহীতে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারক করেন। রাজশাহী দরগাপাড়ায় তাঁর মাজার রয়েছে।
সৈয়দ আহমদ তন্নুরী ওরফে মিরান শাহ (রহ.) (-১৩০৩ খ্রি.) ধর্ম প্রচারে বৃহত্তর নোয়াখালীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে এ সাধকের মাজার অবস্থিত।
সৈয়দ নাসিরউদ্দীন শাহ নেকমর্দান (রহ.) (-১৩০২ খ্রি.) তিনি দিনাজপুর জেলার প্রাচীনতম ইসলাম প্রচারক। ওই অঞ্চলে তিনি সৈয়দ নেকমর্দান বলে পরিচিত। দিনাজপুর জেলার নেকমর্দান গ্রামে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
মখদুম শাহ দৌলাহ শহীদ (রহ.) (-১৩০৭ খ্রি.) ইয়েমেনের অধিবাসী মখদুম শাহ দৌলাহ বৃহত্তর পাবনা জেলার শাহজাদপুর অঞ্চলে আগমন করেন। তিনি বৃহত্তর পাবনা ও বগুড়া অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে পুরনো শাহি মসজিদের পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে তিনি শায়িত আছেন।
শাহ মখদুম রুপোশ (রহ.) (১২১৮-১৩৩১ খ্রি.) তিনি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। রাজশাহী দরগাপাড়ায় তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
শাহজালাল ইয়েমেনি (রহ.) (১২৩৮-১৩৪৬ খ্রি.) বৃহত্তর সিলেট (শ্রীহট্ট) অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। তিনি পূর্ব বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রধান পথিকৃৎ মহান সুফি। সিলেটে তাঁর মাজার অবস্থিত।
শাহ পরাণ (রহ.) শাহজালাল (রহ.)-এর ভাগিনা ও শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে সিলেট অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। সিলেট অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় শাহ পরাণের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। সৈয়দ আহমদ গেছুদারাজ কল্লা শহীদ (রহ.) শাহজালাল (রহ.)-এর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। সিলেটের পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। কুমিল্লার আখাউড়ার খড়মপুর গ্রামে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
শাহরাস্তি বোগদাদি (রহ.) (১২৩৮-১৩৮৮ খ্রি.) ইয়েমেন থেকে হজরত শাহজালালের সঙ্গে যে ১২ জন আউলিয়া এ দেশে আসেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। শাহরাস্তি বোগদাদি (রহ.) ধর্ম প্রচারে চাঁদপুর অঞ্চলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলাধীন শাহরাস্তি পৌরসভার শ্রীপুর গ্রামে বিখ্যাত আউলিয়া হজরত রাস্তি শাহ (রহ.)-এর মাজার অবস্থিত।
শাহ বদর আউলিয়া (-১৩৪০ খ্রি.) ১২ আউলিয়ার পুণ্যভূমি বলে খ্যাত বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। ১২ আউলিয়ার মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। চট্টগ্রাম বখশীর হাটের কাছে বদরপট্টি বা বদরপটি গলিতে তাঁর মাজার অবস্থিত।
খ্রিস্টীয় ১৫-১৬ শতাব্দীতে যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—
খান জাহান আলী (রহ.) (-১৪৫৯ খ্রি.)। তিনি বৃহত্তর যশোর ও খুলনা অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। বাগেরহাটে হজরত খান জাহান আলীর (রহ.) তৈরি করা ৬০ গম্বুজ মসজিদের পাশেই তাঁর পবিত্র মাজার অবস্থিত।
শাহ আলী বোগদাদি (রহ.) (-১৪৯৮ খ্রি.) তিনি বৃহত্তর ফরিদপুর ও ঢাকা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। বর্তমানে ঢাকার মিরপুর ১-এ তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে। দরবেশ শাহ জামাল (রহ.) জামালপুর জেলার শ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। শাহ মোয়াজ্জম দানিশমান্দ ওরফে শাহ দৌলাহ (রহ.) রাজশাহীর বাঘা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। রাজশাহীর বাঘা শাহি মসজিদের পাশে তাঁর মাজার রয়েছে।
সাইয়্যিদ শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুৎ-সাকেন (রহ.) ঢাকা নগরীর সন্নিহিত এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন। ঢাকার দিলকুশায় তাঁর মাজার অবস্থিত।
সৈয়দ শাহ নূর (রহ.) (১৪৭১-১৫৬৮ খ্রি.) বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। রাজশাহী দরগাপাড়ায় শাহ মখদুম রুপোশ (রহ.)-এর মাজারের পাশে তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
খাজা শরফুদ্দীন চিশতী (-১৫৮৯ খ্রি.) তিনি বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। ঢাকা হাইকোর্টের পাশে তাঁর মাজার রয়েছে।
খ্রিস্টীয় ১৭-১৮ শতাব্দীতে যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—আলী শাহান শাহ আদম কাশ্মীরি (রহ.)(-১৬১৩ খ্রি.)। তিনি টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া (আতিয়া) অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত আতিয়া মসজিদের কাছে তাঁর মাজার শরিফ অবস্থিত।
সৈয়দ শাহ নেয়ামত উল্লাহ (রহ.) (-১৬৬৯ খ্রি.) সপ্তদশ শতকে বাংলায় ইসলাম প্রচারক পীর আউলিয়াদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ফিরোজপুরে ঐতিহাসিক তিন গম্বুজ মসজিদ ও তোহখানার পাশে তাঁর মাজার শরিফ অবস্থিত।
শাহ আমানত (রহ.) (-১৭৭৪ খ্রি.) বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। চট্টগ্রাম লালদীঘির পূর্ব পাশে তাঁর মাজার অবস্থিত।
শাহ সুফি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ দায়েম (রহ.) (-১৮০০ খ্রি.) আজিমপুর দায়রা শরিফের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই দরবারের অনেক ভক্ত-মুরিদান রয়েছেন। ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরিফের মধ্যে তাঁর মাজার রয়েছে।
খ্রিস্টীয় ১৯-২০ শতাব্দীতে যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—হজরত আলী আবদুল কাদের সৈয়দ শাহ মুরশিদ আলী আল কাদেরি ওরফে মওলা পাক (১৮৫২-১৯০১ খ্রি.)। তিনি পূর্ববঙ্গের রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পাবনা ও ঢাকা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করেন। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মেদিনীপুর দরগাহ শরিফের অনেক ভক্ত-মুরিদান রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় তাঁর মাজার শরিফ রয়েছে।
শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি (রহ.) (১৮২৬-১৯০৬ খ্রি.) মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় এই দরবারের অনেক ভক্ত-মুরিদান রয়েছেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে তাঁর মাজার রয়েছে। জানশরিফ শাহ সুরেশ্বরী (রহ.) (১৮৫৬-১৯১৯ খ্রি.) শরীয়তপুর জেলার সুরেশ্বর দায়রা শরিফের প্রতিষ্ঠাতা। সুরেশ্বর দায়রা শরিফে তাঁর মাজার রয়েছে। এসব ওলি-আউলিয়ার মাধ্যমে বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসার লাভ করে।
আপনার মতামত জানান