লোকজ মেলায় লোকায়ত জীবনের নির্মোহ রূপ
বাংলার লোকশিল্পের প্রতি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুরাগ ছিল প্রগাঢ়। তাঁর চর্চা আর ধ্যান-জ্ঞানে ছিল লোকজ সংস্কৃতি। বাঙালির মৌলিক চর্চাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ফোকফর্ম। অভিন্ন চাওয়া থেকে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সোনারগাঁয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ লোক কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।
প্রতিবছরের মতো এবারও ১৪ জানুয়ারি সোনারগাঁয়ে শুরু হয়েছে লোকজ মেলা। মাসব্যাপী এই আয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকশিল্পীরা অংশ নিয়েছেন। তাঁদের ৩২টি স্টল ঐতিহ্যবাহী একেকটি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। স্টলে স্টলে স্থান পেয়েছে মৃৎ, কাঁসা-পিতল, শঙ্খ, নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, শোলাসহ বিলুপ্তপ্রায় নানা শিল্পের নিদর্শন। ময়ূরপঙ্খি স্টেজে চলছে জারি-সারি, পুঁথি পাঠসহ লোকগীতি পরিবেশনা।
একটি স্টলে রয়েছে রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি। স্টলের স্বত্বাধিকারী সুশান্ত কুমার পাল জানান, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ৩৫টি সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর দুই ছেলে স্টলে বসেই শখের হাঁড়ি অলঙ্করণ করছিলেন। তাঁদের একজন সঞ্জয় বলেন, ‘দুই ভাই বাবার কাছ থেকেই কাজ শিখেছি। খুব ভালো লাগে।’ অন্য একটি স্টল ঢাকার রায়েরবাগের বিপদ ধরি পালের। তিনি চ্যানেল আই পুরস্কারপ্রাপ্ত শখের হাঁড়ির শিল্পী।
দুটি স্টলে আছে কাঠের পুতুল আর চাকা লাগানো ঘোড়া। সোনারগাঁয়ের ভট্টপুর গ্রামের বীরেন্দ্র সূত্রধর ও আশুতোষ সূত্রধর এই শিল্প ধরে রেখেছেন। আশুতোষের স্ত্রী সন্ধ্যা রানী আপন মনে পাখা সেলাইয়ের কাজ করেন।
কিশোরগঞ্জের সৈয়ালপাড়া গ্রামের আরতি রানী নরম মাটি টিপে অসংখ্য ছোট ছোট ফিগার গড়েছেন। নিখুঁত অবয়ব না হলেও রূপটা এত আদি ও অকৃত্রিম যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তিনি কাজ শিখেছেন মা রেণু রানী পালের কাছে।
সোনারগাঁয়ের দারুশিল্পী হাজি আউয়াল সাহেবের তৈরি শিল্প বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। সুন্দর, নিখুঁত নানা তৈজসপত্র তৈরি করে সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। তিনি এই কারুকাজের ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।
শিল্পী পরেশ চন্দ্র বেত দিয়ে তৈরি করেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ ময়ূরপঙ্খি নৌকা, ট্রাক, মোড়া ও নানারকম খেলনা। প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ আট মাস ধরে বেত দিয়ে নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন একটি নৌকা। তিনি এটিকে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নের নৌকা হিসেবে দর্শনার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন।
বরিশালের শংকর মালাকারের ছেলে নিখিল মালাকার শোলার ফুল ও টোপর তৈরি করেন। তাঁর পরিবারের সবাই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ধাতব শিল্পের চমৎকার একটি স্টল রয়েছে মেলায়। বাকুরার ঘোড়া, মিসরের মূর্তি, হিন্দু মিথলজির নানা চরিত্র গড়েছেন তামা-পিতল-কাঁসা শিল্পী মানিক সরকার।
নানা নকশার শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন হরেন্দ্র কুমার দাস। মৌলভীবাজারের ধূলিজুরা গ্রামের এই বেতশিল্পী জানান, ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি এখন তারা সমকালীন চাহিদার কথাও মাথায় রাখছেন। এ কারণে টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট ইত্যাদিও তৈরি করছেন।
মেলায় সুচি শিল্পের নকশিকাঁথা নিয়ে এসেছেন সোনারগাঁয়ের হোসনেয়ারা বেগম। তাঁর সুঁইয়ের প্রতিটি ফোঁড় যেন কথা বলে। সৌখিনতার গল্প বুনে চলেন। আধুনিক নকশায় প্রাচীন সেলাইয়ের নতুন ফর্ম। এই সুচিশিল্পী বলেন, ‘আমি সুঁই-সুতা দিয়ে আমার স্বপ্ন বুনে যেতে চাই আজীবন।’
মেলা প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিচালক এসএম রেজাউল করিম বলেন, লোকায়ত জীবন ও শিল্পের কাছে গিয়ে নিজেদের ঋদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই লোকজ মেলার আয়োজন।
আপনার মতামত জানান